৯ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৪:৪০

দেশজুড়ে ডেঙ্গু

নজর কেবল শহরে, গ্রামে নেই ডেঙ্গু মোকাবিলার আয়োজন

ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ। মেঝেতেও জায়গা হচ্ছে না। এদিকে ওয়ার্ড ফাঁকা রেখে চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করেন রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে -

সবুজ-শ্যামল সিলেটের জৈন্তাপুরের নিজপাট ইউনিয়ন। এই প্রত্যন্ত জনপদেও এখন দিন নেই, রাত নেই মশার ভনভন। ডেঙ্গুর ভয় মনে ভর করলেও গ্রামের মানুষের করার কিছুই নেই। কারণ, ওই ইউনিয়ন পরিষদে নেই মশা মারার ওষুধ-যন্ত্র, নেই মশককর্মী। নিরুপায় গ্রামবাসী যে যেভাবে পারছে মশা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার পথ খুঁজছে। পাশের দরবস্ত ইউনিয়নেরও প্রায় একই হাল। ওই ইউনিয়ন পরিষদে মশা মারার একটি যন্ত্র থাকলেও সেটা চালানোর মানুষ নেই। কোনো সংস্থা ওষুধও সরবরাহ করেনি কোনো দিন।

শুধু জৈন্তাপুরের এ দুই ইউনিয়নই নয়, সারাদেশে এডিস মশা ছড়িয়ে পড়লেও তৃণমূলে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পরিস্থিতি এমনই হযবরল। সরকারি হিসাবেই ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এর পরও ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়া জেলা-উপজেলা শহর ও গ্রামে মশকনিধন কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়ছে না। সিটি করপোরেশন এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চললেও জনবল ও যন্ত্রপাতির অনেক ঘাটতি রয়েছে। তবে পৌর এলাকার পরিস্থিতি অনেকটাই নাজুক। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রমই নেই। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব ইউনিয়ন পরিষদই মশা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র, ওষুধ ও জনবলশূন্য।

জৈন্তাপুরের দরবস্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহারুল আলম বাহার নিরাশ কণ্ঠে বলেন, ‘এলাকায় প্রচুর মশা, তবে মারার ওষুধ নেই। বারবার ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। তবে কবে যে শক্তিশালী হবে, তা বুঝতে পারছি না।’
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্রাহিম সমকালকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে তো মশা মারার যন্ত্রপাতি দেওয়া হয় না। ওই রকম পরিস্থিতি হলে পৌরসভা থেকে যন্ত্র পাঠিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। প্রতিটি পৌরসভায় মশা মারার যন্ত্র আছে। আর ডেঙ্গু ঢাকায় যতটা, গ্রামে তো তেমন নেই।’ শনিবার বিকেল সোয়া ৫টায় ফোনে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি কুমিল্লায় আছি। ডেঙ্গু দেখার জন্যই এসেছি। তবে এখানে তো ডেঙ্গু নেই।
আপনি যেভাবে মহামারি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, বিষয়টি এ রকম না। এ পরিস্থিতি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা গেছে, গত শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মাদারীপুরের ৯০ জন, ফরিদপুরের ৯৫ জন ও মাগুরার ২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসাইন ইয়াদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলায় মশক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতি ও ওষুধের ঘাটতি রয়েছে। মশাও আছে শহরে। দু-তিন মাস পর পর মশককর্মীদের ওষুধ স্প্রে করতে দেখা যায়।

বরিশালের আগৈলঝাড়ার চেয়ারম্যান আব্দুর রইস সেরনিয়াবাত সমকালকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে উপজেলা পরিষদের নিজস্ব কোনো কার্যক্রম নেই, যন্ত্রপাতিও নেই। অতীতে বিভিন্ন সময় জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের লোকজন এসে মশার ওষুধ ছিটিয়েছে। এবার এ ধরনের কোনো তৎপরতা নেই। আমার সঙ্গে কোনো দপ্তর যোগাযোগও করেনি। তবে মশা পর্যাপ্ত আছে এলাকায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩২৯ জন ভর্তি হয়েছেন, মারা গেছেন একজন। ৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়, ইউনিয়ন পর্যায়েও মশক নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়তা প্রয়োজন।

মশক বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, সিটি করপোরেশনেরই তো প্রয়োজনীয় যান-যন্ত্রপাতি নেই। তাহলে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে কীভাবে থাকবে। পৌরসভাগুলোতে দু-একটি ফগার মেশিন আছে। তাদের রুটিনমতো কাজ করার কোনো লোক নেই। উপজেলা পর্যায়ে তো কোনো কিছুই নেই। তিনি বলেন, এক সময় এডিস মশা শুধু শহরে জন্মাত।

২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ছাত্রাপাড়া নামক একটি অজপাড়াগায়েও অনেক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। সেখানে নারকেলের মালা, কচুর পাতা এমনকি গাছের খোড়লে জমা পানিতে এডিস মশার জন্ম হওয়ার তথ্য মেলে। কাজেই এখন এডিস আর শহুরে মশা নয়। মফস্বল পর্যায়ে তো কোনো মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমই নেই। সেখানে মশা প্রাকৃতিকভাবে বাড়ে ও প্রাকৃতিকভাবে কমে।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ঢাকার যে ডেঙ্গু রোগীর তালিকা তাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে এর মধ্যে অনেক গরল আছে। ঢাকা শহরের রোগীর তালিকার অনেকেই ঢাকার বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় এসেছেন। তাদের নাম রাজধানীর রোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবীর সমকালকে বলেন, প্রতিদিন ঢাকায় যে রোগী দেখানো হচ্ছে, তার একটা বড় অংশ আসছে ঢাকার বাইরে থেকে। তারা একজন আত্মীয়ের বাসায় উঠে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে আত্মীয়ের ঠিকানা ব্যবহার করছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন সরবরাহ করা তালিকার প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করি। তখন দেখা যায়, তালিকার এক-তৃতীয়াংশ রোগী ঢাকার বাইরের। মুগদা, মিটফোর্ড কিংবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর অরিজিন (শেকড়) খুঁজে দেখলেও এই চিত্র পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যেভাবে সক্রিয়ভাবে কাজ করি, জেলা-উপজেলাতেও সেভাবে কাজ করা জরুরি। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক তৎপরতা চালিয়ে ডেঙ্গু বা মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সারাদেশেই এ তৎপরতা চালানো প্রয়োজন।

https://samakal.com/bangladesh/article/2307182223/