৯ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৪:২৭

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বাড়ছে জটিলতা

ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৮২০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যু ২

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক মেডিসিন ইউনিটের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে সাত বছর বয়সি আবরার।

শুক্রবার জ্বরের তীব্রতায় হাতে ক্যানুলা পরানো শিশুটিকে ১নং বিছানায় নেতিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
তার বাবা সাইফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘গত সোমবার রাতে ছেলের হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। দিনে কমলেও রাতে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হয়। সঙ্গে বমি, পেট ব্যথা, শরীর ব্যথা ও খাবারে অরুচি ছিল। জ্বরের শুরু থেকেই মিরপুর সেনপাড়ার স্থানীয় ফার্মাসিস্টের পরামর্শে প্যারাসিটামল (নাপা) খাওয়াচ্ছিলাম। তাতে কোনো উন্নতি না হওয়ায় ওই ফার্মাসিস্টের পরামর্শেই বৃহস্পতিবার থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ এজিথ্রোমাইসিন শুরু করি। এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে।

উপায়ান্তর না দেখে শ্যামলী শিশু হাসপাতলে নিয়ে যাই। শয্যা সংকটে তারা সোহরাওয়ার্দীতে স্থানান্তর করে। এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা সবকিছু শুনে ভর্তি নেন। রক্তের কয়েকটি পরীক্ষা দেন। রিপোর্টে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।’

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কারণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি করতে দেরি হলে অবস্থা আরও খারাপ হতো। ভর্তির পর থেকে টানা স্যালাইন ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে তার।

জানতে চাইলে ওই ওয়ার্ডের দুজন চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, শুধু আবরারই নয়, অনেক ডেঙ্গু জ্বরের রোগী আসছে, যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ খাচ্ছেন। জ্বর সারতে দেরি হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করছেন। এতে শারীরিক জটিলতা আরও বাড়ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে আসছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ইতোমধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে আতঙ্কিত রোগীরা ভাইরাল জ্বরেও অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ সেবন করছেন। তারা বুঝতেও পারছেন না এতে কী ক্ষতি হচ্ছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে।

বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও কোমরবিডিটিতে ভোগা রোগীরা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ (শনিবার) প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় চলতি বছরের রেকর্ড ৮২০ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় ডেঙ্গুতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ভাইরাল ফিভার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেখানে নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন শনাক্ত হয়। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ভাইরাস জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন কোনো উপকারে আসবে না।

অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ জ্বরেও ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না।

ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, অনেকের ডেঙ্গু পজিটিভ হলেও প্রথমে শনাক্ত হচ্ছে না। হয়তো ওষুধ খেয়ে সাময়িকভাবে জ্বর কমেছে। কিন্তু রোগ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ না খাওয়ায় উলটো ফল হচ্ছে। ডেঙ্গুর সঙ্গে সেকেন্ডারি ইনফেকশন অর্থাৎ কোমরবিডিটি বা মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেট্রি হয়। এতে জটিল পরিস্থিতি হয়। তখন চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন।

এ ক্ষেত্রেও জ্বর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার আগে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া একেবারেই অনুচিত। কিন্তু অনেক ফার্মাসিস্ট ও অভিভাবক রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে উদ্বুদ্ধ করেন।

অন্যদিকে ডেঙ্গু জ্বর চলে যাওয়ার পর কয়েক দিন ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড থাকে। এ সময় রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়াসহ শরীরে রক্তক্ষরণ হয়ে রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। শক সিনড্রোমের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, নিউমোনিয়া, হার্ট, লাং, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস সমস্যা বেশি থাকলে রোগী মারাও যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এখন সর্দি জ্বর হলেই রোগীরা অস্থির হয়ে যান। ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসকরাও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেন। রোগটি সাধারণ জ্বর নাকি ডেঙ্গু, শনাক্ত করেন না। ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত কয়েক স্তরের হয়ে থাকে। যেমন-ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর, হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বর (ডিএইচএফ) এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (ডিএসএস)। ডিএসএস হলো ডিএইচএফের পরের ধাপ এবং যা খুবই বিপজ্জনক। শরীরের ফ্লুইড বের হয়ে যাওয়ার কারণে রোগী হঠাৎ শকে চলে গিয়ে মারাও যেত পারে।

এ ক্ষেত্রে রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করাতে হবে। মারাত্মক রোগীর ক্ষেত্রে পানিস্বল্পতা ও রক্তক্ষরণের চিকিৎসার জন্য আইভি স্যালাইন বা রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।
তারা আরও বলেন, জ্বরভাব দেখা দিলেই আগে ডেঙ্গুর এনএস-ওয়ান পরীক্ষা করতে হবে। পজিটিভ হলে ডেঙ্গু ভাইরাস আইজিজি এবং আইজিএম পরীক্ষা করাতে হবে। আইজিএম পজিটিভ হলে বুঝতে হবে প্রাথমিক সংক্রমণ। আর আইজিজি পজিটিভ হলে সেটি সেকেন্ডারি ইনফেকশন পজিটিভ। এ সময় দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। না হলে মৃত্যুঝুঁকি থাকবে।

২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৮২০ রোগী হাসপাতালে, ২ মৃত্যু: এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় এই বছরের রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮২০ জন, মারা গেছেন দুজন। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৮২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার মধ্যে ৬০৩ জনই ঢাকায় এবং ২১৭ জন ঢাকার বাইরের। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১২ হাজার ১১৮ জনে দাঁড়িয়েছে। গত একদিনে দুজন মারা যাওয়ায় ডেঙ্গুতে এ বছর ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, জুলাই মাসের প্রথম ছয় দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজারের (৪১৪০) বেশি মানুষ। এ ছাড়া জুলাইয়ে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবার বর্ষা মৌসুমের আগেই এডিস মশাবাহিত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। গত রোববার দেশে ৫০৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২ হাজার ৫০২ জন। এদের মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৭৭৩ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭২৯ জন।

মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন এবং জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন, মে মাসে দুজন এবং জুন মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ‘ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে’ ভুগছিলেন এবং ‘শক সিনড্রোমে’ মারা গেছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/693753/