৯ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৪:১৯

সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি ৮২০ ঢাকার সর্বত্র ডেঙ্গু আতঙ্ক

ঢাকার সর্বত্র এখন ডেঙ্গুর আতঙ্ক, বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তিত। কারণ শিশু মশা যেমন তাড়াতেও পারে না তেমনি মশা মারতেও পারে না। মশা কামড়ে গেলেও বুঝতে পারে না। গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে ৮২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হলেও এর ৬০৩ জনই রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে দুইজন। গতকাল সকাল পর্যন্ত সারা দেশে চলতি জুলাই মাসের সাত দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে চার হাজার ১৪০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের।

সিটি করপোরেশনের ফগিংয়ের (মেশিনের মাধ্যমে কীটনাশকসংবলিত ধোঁয়া ছড়ানো) মধ্যে মশা ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। আবার ফগিংয়ের ধোঁয়ায় মশা মাটিতে পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ কাতরালেও কিছুক্ষণ পর সেই মশাই আবার উড়ে চলে যাচ্ছে এমন তথ্যও জানিয়েছেন অনেকে। ফলে মশা না মরে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে বলে ঢাকার অনেক মানুষ বলছে। ফলে ঢাকার সর্বত্র এখন ডেঙ্গু আতঙ্ক। অবশ্য ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ঢাকার বাইরের রোগীরাও ভর্তি হচ্ছে। এদের অনেকেই রোগের জটিলতা নিয়ে ঢাকায় আসে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী বেশি। এর মধ্যে নগরীর মুগদা হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ১২৭ জন, পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ১০৯ জন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫৮ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৩০ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ২৩ জন, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ১২ জন, বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে ২৪ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ১৮ জন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন, ইসলামী ব্যাংক কাকরাইল হাসপাতালে ১৩-সহ গতকাল রাজধানীতে মোট ৬০৩ রোগী ভর্তি হয়েছে।

গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকার বিভিন্ন অংশে অভিযান চালিয়েছে এডিস মশার উৎপাদন হয় এমন স্থান খুঁজতে। এই অভিযানে মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি কর্তৃপক্ষকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে সেখানে ডেঙ্গু মশা পাওয়া গেছে এই অভিযোগে।

বয়স্করা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারেন, তারা দিনের বেলা মশারি টানিয়ে ঘুমাতে পারেন; কিন্তু শিশুরা এ ধরনের কোনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারে না বলে ডেঙ্গুতে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদারের বিকল্প নেই বলে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: আহমদ পারভেজ জাবীন বলছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ইনচার্জ ডা: মো: জাহিদুল ইসলাম বলছেন, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ৫০৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন আছেন এক হাজার ৭৭৩ জন। শুধু ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য ঢাকার হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য রোগী চিকিৎসা করা কঠিন হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, চিকিৎসার দিকে মনোযোগ না দিয়ে সরকারের উচিত প্রতিরোধে ব্যবস্থা জোরদার করা। প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারলে মানুষের যেমন ভোগান্তি কমে যাবে তেমনি সরকার ও সাধারণ মানুষের অর্থ খরচও কমে যাবে। সিটি করপোরেশন অথবা স্থানীয় সরকার পরিষদকে মশক নিধন ও মশা উৎপাদনের পরিবেশ ধ্বংস করে দিতে হবে।
সমন্বয়হীনতায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি সঙ্কটে : টিআইবি

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয়, যথাযথ পরিকল্পনা, পূর্বপ্রস্তুতি ও কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতির কারণেই ঢাকাসহ সারা দেশে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে, এ জাতীয় সতর্কবার্তা ছিল। এরপরেও রাজধানীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ হতাশাজনক। বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ছিল না। যেটুকু উদ্যোগ দেখা গেছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় তা লোক দেখানো প্রচারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি রোধ করার যে সম্ভাবনা ছিল সে দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি বাস্তবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

পরিস্থিতি সামলানোর উপায় তুলে ধরে ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবৃতিতে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে মুনাফাভিত্তিক কীটনাশক নির্ভরতার ঊর্ধ্বে গিয়ে অন্যান্য সব প্রকার পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করে দুই সিটি করপোরেশনকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাথে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কোভিড সঙ্কটের অভিজ্ঞতার আলোকে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞজনকে সম্পৃক্ত করে পরামর্শক প্যানেল গঠন ও যথাযথ গুরুত্বসহকারে নিয়মিতভাবে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বছরব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনায় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সম্ভাব্য সব মাধ্যমে এডিস মশা ও এর লার্ভা, ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ ও দ্রুত চিকিৎসার বিষয়ে জনসচেতনতা ও সতর্কতামূলক বার্তা প্রচারের পরামর্শ দেন তিনি।

রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশেই এখন ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। তাই এটিকে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য সঙ্কট’ ঘোষণা দিয়ে জাতীয়পর্যায় থেকে সমন্বিতভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকার বাইরের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষমতার ঘাটতি জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু

ময়মনসিংহ অফিস জানায়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আব্দুর রাজ্জাক (৫০) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি গাজীপুর জেলার মাওনায় শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। বিকেলে তিনি মারা যান। তার বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায়। এর আগে গত রোববার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরের বিলকিস আক্তার মারা যান। তিনি ঢাকায় ধানমন্ডি এলাকায় বসবাস করতেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু বিভাগের চিকিৎসক ডা: ফরহাদ হোসেন হীরা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পাঁচজন ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে মোট ভর্তি রয়েছেন ২৩ জন। ভর্তিকৃত সকলেই ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা হলেও রাজধানী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসকালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
রাজশাহীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যু

রাজশাহী ব্যুরো জানায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহীতে প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যু হলো। রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শনিবার সকালে তার মৃত্যু হয়।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই রোগীর নাম পাপ্পু (২৫)। তিনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ঢাকাচন্দ্রগাঁতি গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে। দুপুরে তার লাশ বাঘার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেছে পরিবার। বাদ আসর নামাজে জানাজা শেষে তার লাশ দাফনের কথা রয়েছে।

মৃত পাপ্পুর স্ত্রী অঞ্জনা খাতুন জানান, তার স্বামী ঢাকার মুন্সীগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সিকিউরিটি গার্ড পদে চাকরি করতেন। ঈদের দুই দিন আগে সেখানেই জ্বরে আক্রান্ত হন। তীব্র জ্বর নিয়ে তিনি ঈদের পরের দিন বাড়িতে ফিরে আসেন। তারপর গত ২ জুলাই তাকে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহম্মেদ জানান, পাপ্পুকে গত ২ জুলাই ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হলে গত ৪ জুলাই তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তিনি আরো জানান, গত জুন মাস থেকে রামেক হাসপাতালে ডেঙ্গজ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি শুরু হয়েছে। শনিবার আটজন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ পর্যন্ত ২৭ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। আর চলতি মৌসুমে চিকিৎসা নিতে রামেক হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে পাপ্পুই প্রথম মারা গেলেন বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/760866/