৯ জুলাই ২০২৩, রবিবার, ৪:১৪

ক্রুড অয়েল খালাস প্রক্রিয়ার শুরুতেই হোঁচট !

কক্সবাজারের মহেশখালী উপকূলের গভীর সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে নির্মিত পাইপলাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) খালাস প্রক্রিয়ার শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বহুল আলোচিত পাইপলাইন ফেটে যাওয়ায় তেল খালাস প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে এখন।

গতকাল শনিবার দুপুরে এই তথ্য নিশ্চিত করেন বিপিসি নিয়ন্ত্রাণাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান। তিনি বলেন, দেশে প্রথমবারের নির্মিত কক্সবাজারের মহেশখালী উপকূলের গভীর সমুদ্রে স্থাপিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গত ৩ জুলাই সোমবার সকাল সোয়া ১০টায় সরাসরি জাহাজ থেকে তেল খালাস শুরু হয়। কিন্তু ৬ জুলাই বুধবার বিকেল ৩টার দিকে পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে বহুল প্রতীক্ষিত এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যা পুনরায় চালু করা আর সম্ভব হয়নি।

এই কর্মকর্তা বলেন, পাইপলাইন ঠিক করতে কত সময় লাগবে তাও নিশ্চিত নয় এখনো। পাইপলাইনে তেল খালাস প্রক্রিয়াটি যেহেতু পরীক্ষামূলক ছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকল্পটি আমরা এখনো বুঝে নিইনি। যে কারণে ত্রুটি সেরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি আমাদের বুঝিয়ে দেবে।

লোকমান বলেন, পাইপলাইনে জাহাজ থেকে ৭-৮ হাজার টনের মতো তেল খালাস হয়। জাহাজ থেকে বাকি তেল আগের পদ্ধতিতে শিপিং করপোরেশনের লাইটার ট্যাঙ্কারে করে পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া হবে।

বিপিসির বিপণন কর্মকর্তা মোরশেদ হোসেন বলেন, জাহাজ থেকে খালাস হওয়া তেলের চাপে ফুটো হয়ে যায় পাইপলাইন। পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে এমনটাই হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাইপলাইন ফেটে বেশ কিছু তেল সাগরেও মিশেছে। যে কারণে তড়িঘড়ি করে তেল খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

বিপিসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জাহাজ এমটি হোরে ৮২ হাজার টন অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) নিয়ে সৌদি আরব থেকে ২৪ জুন মাতাবাড়িতে পৌঁছে। বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কারটি ২২৯ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফটের। ২৫ জুন তেল খালাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৮ জুন পর্যন্ত কমিশনিং কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়।
এরপর গত ২ জুলাই রোববার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয় দফায় কমিশনিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরদিন সোমবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে মাদার ভেসেল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাস শুরু হয়। যা ৩০ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু পাইপলাইন ফেটে গিয়ে তেল খালাস প্রক্রিয়ার শুরুতে হোঁচট খেল বিপিসি।
বিপিসি সূত্র আরও জানায়, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের উপকূল থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে এসপিএম স্থাপন করা হয়। যেখান থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি আলাদা পাইপলাইন দিয়ে তেল প্রথমে নিয়ে আসার কথা কালারমারছড়ায় সিএসটিএফ বা পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাঙ্ক ফার্মে। সেখান থেকে বিভিন্ন পাম্পের মাধ্যমে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন দিয়ে তেল নিয়ে যাওয়া হবে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে।

এসব পাইপলাইনে ২০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এসপিএম থেকে মহেশখালীতে এসে যেখানে পাম্প হবে, সেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল থাকবে এক লাখ ২৫ হাজার টন। বাকি ৭৫ হাজার টন হবে ডিজেল বা পরিশোধিত তেল। এর মানে হচ্ছে এই পাইপলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে তেলের সংরক্ষণ ক্ষমতাও বেড়েছে। বর্তমানে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঁচ লাখ টন সংরক্ষণ ক্ষমতা আছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল সংরক্ষণ ক্ষমতা দুই লাখ ২৫ হাজার টন। বাকিটা পরিশোধিত তেল রাখার স্টোরেজ।

ইআরএলের তথ্যমতে, বর্তমানে পরিশোধিত (রিফাইন্ড) এবং অপরিশোধিত (ক্রুড অয়েল) মিলে বছরে ৬০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর পুরোটা আনা হয় সাগরপথে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা জ্বালানি তেলবাহী বড় বড় অয়েল ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নিত। ওখান থেকে লাইটার ট্যাংকারে করে তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাংকে।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিপিসির কোটি কোটি টাকা খরচ হতো এবং দীর্ঘ সময় লাগত। লাইটারেজ করার সময় নানা কারণে অপচয়সহ বিপুল পরিমাণ তেল চুরি হতো। জ্বালানি তেল খালাসের মান্ধাতার আমলের এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বিশেষ করে মাদার ভ্যাসেল বসিয়ে রাখা এবং বিএসসির দুটি জাহাজ দিয়ে তেল লাইটারিং করতে বিপিসির বছরে খরচ হতো প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

https://dailysangram.info/post/529393