৮ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১২:১১

বাচ্চুর উত্থান যেভাবে

ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা। এরশাদ জমানায় হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। এরপর হন বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। বেশ ক’বছর ধরে বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা হিসেবে পরিচিত দেশব্যাপী। জাতীয় পার্টির এই নেতা একসময় হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন। যার সুবাধেই তিনি বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। তার আমলেই বেসিক ব্যাংককে ফোকলা করে ছাড়েন তিনি। এই আবদুল হাই বাচ্চুর উত্থান কাহিনী সংক্ষেপে এটাই।

কিন্তু শুরুটা কেমন ছিল? বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার আড়ুয়াডিহি গ্রামে তার বাড়ি। বাবা শেখ আবদুল হামিদ পুলিশে কর্মরত ছিলেন।

সে সময় টেনে-টুনে চলতো তাদের সংসার। আবদুল হামিদ চাকরি থেকে অবসরে গেলে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন। আট ভাই-বোনের মধ্যে বাচ্চু দ্বিতীয়। ছাত্র জীবনে দীর্ঘ সময় অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করেছেন। এরপর পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কেটেছে গোপালগঞ্জ শহরে। অভাব ঘোচাতে চলে আসেন ঢাকায়। তারপর পরিচিত একজনের মাধ্যমে একটি চক কারখানায় কাজ শুরু করেন। সেইসঙ্গে শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা। ওই সময় জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

এরশাদ আমলে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়ে যান। নির্বাচনে জয়ীও হন। এছাড়া ১৯৮৮ সালের ১২ই অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনেও বাচ্চু জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে বাগেরহাট-১ আসন থেকে লড়াই করেন। কিন্তু সে নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি। এরপর বেশ কিছুদিন বাচ্চু রাজনীতিতে নীরব ছিলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। এক সময় মিশে যান আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০০৯ সালে আবদুল হাই বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। ২০১৪ সালে ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন।

বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে এসে ঘুরে যায় তার জীবনের মোড়। এখান থেকেই শুরু হয় তার অন্যরকম এক উত্থান। এলাকায় যেতে থাকেন ঘন ঘন। দান-খয়রাতও করতে থাকেন। এভাবেই বাচ্চুকে সবাই দানবীর হিসেবে চেনেন। এলাকায় গেলে তার বাড়িতে মানুষের লাইন পড়তো। চলাচল করতেন দামি গাড়িতে। গ্রামে নিয়ে যেতেন গাড়ির বহর। সামনে-পিছনে থাকতো পুলিশি প্রটোকল।
সরজমিন বাগেরহাটের মোল্লাহাট ঘুরে জানা গেছে, বহুল অলোচিত আবদুল হাই বাচ্চুর নানা তথ্য। পুরনো টিনশেডের বাড়ি ভেঙে করেছেন আলিশান বাড়ি। গ্রামজুড়ে এত বড় ফটকের বাড়ি আর দ্বিতীয়টি নেই। দেয়ালে টাইল্‌স করা। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সদর দরজায় ঝুলছে তালা। বাড়ির ভেতরে সুনসান নীরবতা। বাড়ির মূল ফটকের পশ্চিম পাশে লেখা ‘শেখ হামিদ ও ছাবেদা ভিলা।’ বাবা শেখ আবদুল হামিদ ১৯৮৮ সালে মারা যান। মা ছাবেদা বেগম ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় বাচ্চুর বনানীর বাসায় মৃত্যুবরণ করেন।

বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ার পর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তিনি দেশে না বিদেশে তার কোনো সুনির্দিষ্ট বা সুস্পষ্ট তথ্য নেই কারো কাছে। এদিকে ঢাকায় বাড়ি কিনেছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। সেখানে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন। স্থানীয়রা জানান, তাদের পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকতেন। ঢাকা থেকে মাঝে- মধ্যে তার ছোট ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্না ও তার পরিবার নিয়ে গ্রামে যেতেন। বেসিক ব্যাংকে এলাকার অনেককে চাকরি দিয়েছেন বাচ্চু।

বাচ্চুর গ্রামের ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি বলেন, তার বাবা যখন চাকরি করতেন তখন মোটামুটিভাবে তাদের সংসার চলতো। এরপর অবস্থা খুব একটা ভালো যায়নি। অভাব- অনটনে থাকতো। একটা সময় বাচ্চু মানুষের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। এরপর ঢাকা চলে যান। হঠাৎ শুনতে পাই বাচ্চু জাতীয় পার্টির নেতা। এলাকার এমপি প্রার্থী। এরপর এমপিও হন। ডিস্ট্রিক্ট চেয়ারম্যানও ছিলেন।
এ সময় খুব একটা পরিবর্তন না হলেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে পরিবর্তন হয় তার। রফিক নামের একজন বলেন, বাচ্চু ভাই এলাকায় অনেক কিছু করেছেন। অনেক দিন ধরে তিনি গ্রামে আসেন না।

হাসনা নামে এক নারী বলেন, তাদের একটি আটচালা টিনের ঘর ছিল। সেটিও তার এক স্বজন কিনে দিয়েছিলেন। তার বাবার চাকরি যাওয়ার পর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তখন মানুষের বাড়িতে গিয়েও খাবার খেয়েছে। এরপর গোপালগঞ্জ ভাড়া বাসায় চলে যায়। সেখানে ছিল তার মামাবাড়ি। ভাই-বোনগুলো সবাই ছোট ছিল। কাজের জন্য এদিক-সেদিক সবাই বেরিয়ে যান। ঢাকা যাওয়ার পর মোটামুটি অবস্থা ভালো হতে থাকে। এরপর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

লতিফ নামে এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন তার বনানীর বাসায় থাকতেন। তার বাড়ি বাচ্চুর গ্রামের বাড়ির এলাকায়। বাসার বাজার সদাই থেকে শুরু করে তার ছেলেকে দেখাশোনা করতেন। তিনি বলেন, অনেকদিন বাচ্চুর বাড়িতে তিনি থাকেন না। তারা সবাই বিদেশে চলে যাওয়ায় তিনিও গ্রামে চলে গেছেন। অনেক আগে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
মোল্লাহাটের আড়ুয়াডিহি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মারুফ মোল্লা মানবজমিনকে বলেন, বাচ্চু দেড়-দুই বছর আগে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির কোনো মামলাতেই শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। যে কারণে দুদককে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। মামলার দীর্ঘ ৮ বছর পর চার্জশিটে তাকে আসামি করা হয়। অনুমোদিত চার্জশিটে আসামিদের বিরুদ্ধে মোট ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ৪৬ জন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ১০১ জন গ্রাহকসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি রয়েছেন।

গত ১২ই জুন বেসিক ব্যাংকের আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক। সংস্থাটির দায়ের করা মোট ৫৯ মামলার চার্জশিটের মধ্যে ৫৮টি মামলার তদন্তে নতুন আসামি হিসেবে আলোচিত আবদুল হাই বাচ্চু ও কোম্পানি সচিব শাহ আলম ভূঁইয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। কিন্তু আবদুল হাই বাচ্চু এখন পলাতক। তিনি কোথায় আছেন কেউ জানেন না।


https://mzamin.com/news.php?news=63566