৮ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১২:০৩

মশকনিধনের উদ্যোগই নেই ট্রেন বাস লঞ্চে

স্টেশন, স্ট্যান্ড, ঘাটে ছিটানো হয় না ওষুধ

রাজধানীসহ সারা দেশেই দিন দিন বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি। এক রত্তির মশার কামড় মানুষের প্রাণ কাড়লেও ট্রেন, বাস, লঞ্চে ওষুধ ছিটানোর উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। এসব যানবাহনে দিনে-রাতে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও মশার ওষুধ ছিটানোর বালাই নেই।

একই সঙ্গে ট্রেনস্টেশন-বাসস্ট্যান্ড ও লঞ্চঘাটের মশা নিয়ে কারও যেন মাথা ব্যথাই নেই। সংশ্লিষ্টরা ডেঙ্গুর এ মৌসুমে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ গণপরিবহণ ও স্টেশনগুলোতে ওষুধ ছিটানোর প্রয়োজনও বোধ করছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর ১৪টি এলাকার জরিপ ফলাফলে-এডিস মশার লার্ভা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত টায়ারে। আর এডিস মশা সবচেয়ে বেশি মিলেছে বাসটার্মিনাল, বাস ডিপো ও রেলস্টেশনে। অথচ বিগত যে কোনো বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর বংশ বিস্তার সবচেয়ে বেশি। তারপরও গণপরিবহণ এবং গণপরিবহণের স্থানগুলোতে মশার ওষুধ ছিটানোর উদ্যোগ নেই।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ অন্তত ১০টি স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনগুলো যেন মশার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি ট্রেনেই মশার কামড়ে সাধারণ যাত্রীরা অতিষ্ঠ। রাত-দিন মিলে রেলে প্রায় ৩৬৪টি ট্রেন চলাচল করছে। ৫০৭টি রেলওয়ে স্টেশন ও ট্রেন ঘিরে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী রেলপথে চলাচল করছেন। স্টেশন বা ট্রেনের কোথাও ডেঙ্গু নিধনে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়েনি।

স্টেশন এবং অধিকাংশ ট্রেন স্যাঁতসেঁতে থাকে। লাইনকেন্দ্রিক পানি জমে থাকায় একেকটি স্টেশন মশার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। যাত্রীরা অনেক সময় স্টেশনে মশার কয়েল জ্বালিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করেন। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ এমন অন্তত অর্ধশতাধিক যাত্রী জানিয়েছেন, রেলে মশা মারার কোনো কার্যক্রম তাদের চোখে পড়েনি। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার পক্ষ থেকে ওষুধ ছিটানো-ধোঁয়া মেশিনের মাধ্যমে মশা নিধনের উদ্যোগও তারা দেখেননি বলে জানিয়েছেন।

রাজশাহীগামী যাত্রী জিল্লুর রহমান জানান, সাধারণ সময়েও ট্রেনে প্রচুর মশা থাকে। ডেঙ্গুর এ সময়ে মশার উৎপাত আরও বেড়েছে। কেবিন বা চেয়ার কোচ, ট্রেনের সব জায়গাই মশার নিরাপদ আবাসে পরিণত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রেনের একাধিক অ্যাটেনডেন্ট জানান, মশানাশক অ্যারোসল স্প্রে করা হলেও কোনো কাজ হয় না। মশা চেয়ার এবং কেবিনের কোণায় কোণায় লুকিয়ে থাকে।

যাত্রীদের অভিযোগ, শুধুমাত্র কেবিনে নামে মাত্র স্প্রে করা হয়। বোতল থেকে স্প্রে বেরও হয় না, খালি বোতলেই লোক দেখানো স্প্রে করা হয়-এতে মশা মরা তো দূরের কথা, মশার কিছুই হয় না।

কমলাপুর স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, স্টেশনে ৭টি প্লাটফর্মে ১৫টি রেললাইন রয়েছে। অধিকাংশ লাইনই স্যাঁতসেঁতে। তাছাড়া অপেক্ষমাণ ট্রেনে টয়লেট ও পানির কল ব্যবহৃত হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে মলমূত্র ভরা কালচে পানি জমে। এসব নোংরা স্থানে মশা খেলা করে। এসব স্থানে জন্মানো মশাগুলো খুব সহজেই ট্রেনে উঠে। ট্রেনের দরজা, জানালা খোলাই থাকে। টয়লেটের নিচের অংশ দিয়েও ট্রেনে মশা ঢোকে। সিটি করপোরেশন থেকে স্টেশনের ভেতর বা ট্রেনে মশার ওষুধ ছিটানো হয় না।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ প্রতিটি স্টেশন, ট্রেনে মশার উৎপাত তো রয়েছেই। আমরা চেষ্টা করি যাত্রার আগে মশানাশক অ্যারোসল স্প্রে করার। প্রতিটি ট্রেনেই তা করা হয়। তবে স্টেশন এবং ট্রেনগুলো বিভিন্ন সিটি করপোরেশন-পৌরসভার আওতায় পড়ে। সেখান থেকে নিয়মিত ডেঙ্গু নিধন ওষুধ ছিটানো হলে সবচেয়ে কার্যকর হতো। ডেঙ্গুর হাত থেকে রেহাই পেতে তিনি ট্রেন যাত্রীদের মশা নিরোধ স্প্রে, মলম সঙ্গে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, স্টেশন ও ট্রেনগুলোতে মশা নিধন স্প্রে করা হয়। তবে স্টেশন, স্টেশনকেন্দ্রিক ড্রেনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ওপর সবচেয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরগুলো যদি রেলে মশা নিধনে তৎপরতা চালায় সবচেয়ে ভালো হয়।

বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে কোথাও মশা মারার ওষুধ ছিটানোর তৎপরতা নেই। একাধিক বাস হেলপার জানান, যাত্রীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করলে কখনো কখনো স্প্রে করা হয়। মাঝে মধ্যে রাতে স্প্রে করা হলেও দিনে কখনোই করা হয়নি। অথচ দিন-রাত সব সময়ই মশা বাসের ভেতরে থাকে। বাসস্ট্যান্ডগুলো যেন মশার আখড়া।

সায়েদাবাদ টার্মিনালের কাউন্টারম্যান সোহেল মিয়া জানান, দূরপাল্লার বাসগুলোতে কখনো কখনো স্প্রে করা হয়। সেটার প্রভাব আর কতক্ষণ থাকে। বাস মালিক অ্যারোসল সব সময় কিনেও দেন না। লোকাল বাসগুলোতে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলে। এসব বাসে রয়েছে মশার কারখানা। অনাবিল বাসের এক সহকারী জানান, রাজধানীতে শত শত বাস চলাচল করছে। এসব বাসে স্প্রে করাতো প্রশ্নই ওঠে না। কারও কাছেই স্প্রে থাকে না। বাসে স্প্রে ছিটানো হয়-এমনটা তিনি কোনো দিন দেখেননি।

পরিবহণ মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বাস এবং বাস টার্মিনালগুলোতে মশার উৎপাত সব সময়ই থাকে। বাসগুলোতে স্প্রে করার নির্দেশ দেওয়া হলেও কখনো দেওয়া হয়, কখনো হয় না। টার্মিনালগুলোতে মশার পর্যাপ্ত ওষুধ ছিটানো জরুরি। সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করব-শুধু টার্মিনাল নয়, স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের ভেতরও ওষুধ ছিটানো হোক।

রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডের মতো লঞ্চঘাট ও লঞ্চের ভেতরও যথারীতি মশার উৎপাত রয়েছে। লঞ্চঘাটে কখনো কখনো ওষুধ ছিটানো হলেও লঞ্চের ভেতর ওষুধ বা ম্প্রে করা হয় না। কিছু কিছু লঞ্চে স্প্রে করা হলেও অধিকাংশ লঞ্চে মশা নিধনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লঞ্চের এক সহকারী জানান, লঞ্চের অধিকাংশ জায়গা খোলা অবস্থায় থাকে। উম্মুক্ত স্থানে স্প্রে করা হলেও আসলে কোনো কাজে আসে না। লঞ্চঘাটগুলো মশামুক্ত করা সবচেয়ে জরুরি।

বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম-পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, বাস-ট্রেন বা লঞ্চে সাধারণ যাত্রীরা বসে-ঘুমিয়ে থাকেন। এসব গণপরিবহণে মশা নিধন সবচেয়ে জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টদেরও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ওষুধ ছিটানোর কোনো বিকল্প নেই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/693441