২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৩

চারদিকে বিদ্বেষের বিষাক্ত নিঃশ্বাস

ইতিহাসের এতগুলো বছর পাড়ি দিয়ে মানব-সভ্যতা এখন কোথায় এসে দাঁড়ালো? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ঝলমলে এই সভ্যতায় আমরা কথাও বলি চমৎকার। কথা বলার সময় মনে হয়- মানুষ নয়, সবাই যেন ফেরেশতা! যে দেশ যত বড় তার কথাও তত বড়। যে মানুষ যত বড় নেতা, তার বাক্য বিন্যাস তত চমৎকার। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কথামালার এসব সৌরভ কিন্তু সভ্যতার শাসকদের আচরণে লক্ষ্য করা যায় না। তাহলে সবই কি অভিনয়? আসলে কথামালার রাজনীতির সাথে বর্তমান সময়ে আচরণের যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে মনে হয় বিশ্ব রাজনীতি যেন এক রঙ্গমঞ্চ, আর রাজনীতিবিদরা শুধুই অভিনেতা-অভিনেত্রী। প্রহসনের এমন রাজনীতি কিংবা সভ্যতা মানব জাতি এর আগে কখনও লক্ষ্য করেনি।

বর্তমান সভ্যতার এক অবাক উদাহরণ লক্ষ্য করা গেল ইতালিতে। ইতালির রোমে বিমানবন্দরে লন্ডনের ফ্লাইট ধরতে এসে নিরাপত্তা কর্মীদের জবরদস্তিতে হিজাব খুলতে বাধ্য হলেন এক মুসলিম নারী। বিমান বন্দরে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়া ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক আজনিয়া আজকিয়া। তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মুসলমান হওয়ার কারণেই তার সাথে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। কারণ একই ফ্লাইটে খ্রীস্টান নানদের মাথার কাপড়ের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেনি নিরাপত্তা বাহিনী। উল্লেখ্য যে, ঘটনার সময় তিনি একটি ভিডিও ধারণে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় আইনে নিরাপত্তা তল্লাশির সময় হিজাব খোলার বাধ্যবাধকতা কোথায় আছে তা কড়া ভাষায় নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে জিজ্ঞাসা করছেন আজনিয়া আজকিয়া। তখন সেখানে উপস্থিত সকল নারী নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে বলেন, ‘তুমি নিরাপদ নও, তোমার চুলের ভেতর কিছু লুকিয়ে রাখতে পার। যদি তুমি এটা না খুলে রাখ আমরা বুঝতে পারব না এটার ভেতর কিছু লুকিয়ে রেখেছ কিনা।’ আজনিয়া তখন আলাদা কোন রুমে গিয়ে হিজাব খুলে তল্লাশির প্রস্তাব দেয় নিরাপত্তা কর্মীদের। ‘মুসলিম’ উল্লেখ করে তার এই প্রস্তাবে আপত্তি তোলা হয়, তাকে মূলত অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়।
এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত এই খবরটি বিশ্লেষণ করলে বর্তমান সভ্যতার একটি চিত্র বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করা যায়। মুখে মুখে উদারতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ন্যায় ও মানবতার কথা যতো উচ্চ কণ্ঠেই উচ্চারণ করা হোক না কেন পাশ্চাত্যের মানসিকতায় আসলে বড় ধরনের সংকট বিরাজ করছে। সেই সংকটের কারণেই তারা মুসলমানদের সাথে ভুল আচরণ করছে। নানা ক্ষেত্রে তাদের ভ্রষ্ট আচরণের কারণেই বর্তমান বিশ্বে সংকটের মাত্রা বাড়ছে। বর্তমান সময়ে বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের যে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে তার নাট্যকার এবং পরিচালকও তারা। এই সত্য তো এখন বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিনয়ের বদলে এখন তো তারা ‘ন্যায়ের সভ্যতা’ ধারণ করতে পারেন। কিন্তু তেমন লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। আর শুধু পাশ্চাত্যে নয়, প্রাচ্যেও চলছে মুসলিম বিরোধী নানা তৎপরতা। ষড়যন্ত্রের মাত্রা দিনদিনই বেড়ে চলেছে।
পার্বত্য এলাকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠে। ২৪ এপ্রিল মুদ্রিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সবুজে ঘেরা পার্বত্য এলাকায় নতুন দাবানলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখানে মিয়ানমারের উগ্রপন্থী একটি গ্রুপ তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকারের খাস জমি দখল করে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তুলেছে ‘ভাবনাকেন্দ্র’ বা কিয়াং। ভাবনাকেন্দ্রে বসেই মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ‘৯৬৯’ নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে উপজাতিদের।
মিয়ানমারের ৩৫ জনের বেশি নাগরিক এ কাজে জড়িত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে। তারা ধর্মযাজক বা ভান্তে সেজে পাহাড়ীদের মধ্যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। গত কয়েক মাসে তারা পার্বত্য এলাকায় ২৫ হাজারের বেশি অনুসারী তৈরি করেছে। মিয়ানমারের এই ভান্তেরা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির ও রাঙ্গামাটির বনবিহারে ও রাজবন বিহারে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
তাদের পরামর্শে এই তিনটি প্যাগোডা এখন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিহারগুলোতে গত কয়েক মাস ধরে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে এখন জুডো-ক্যারাতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা বনে ঢুকে পড়ছে। বনে গিয়ে তারা উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। পরে তারা জুম্মুল্যান্ড গড়ার আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, সরেজমিনে পার্বত্য এলাকার রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মিয়ানমারের এক নাগরিক ভান্তে সেজে এমন কর্মকা- পরিচালনা করছিল। যৌথ বাহিনী গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে মিয়ানমারের মুদ্রাসহ (এক লাখ ৫৫ হাজার কিয়াত) গ্রেফতার করে। উল্লেখ্য যে, মিয়ানমারের মুদ্রার নাম হলো ‘কিয়াত’। গ্রেফতারের পর যৌথবাহিনী তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। সে বলেছে, পাহাড়ে তার মতো প্রায় শতাধিক ভান্তে রয়েছে। পাহাড়ের উপজাতিরা যাতে বাঙালিদের ওপর বিষিয়ে ওঠে সেজন্য তারা কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, এরকম কয়েকশ’ ভান্তে পার্বত্য এলাকায় কাজ করে যাচ্ছে। যাদের চেনার তেমন উপায় নেই। কারণ পার্বত্য এলাকার উপজাতি গোষ্ঠীর মানুষের মতোই তাদের চেহারা বা রেস।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউপিডিএফ, জেএসএস ও জেএসএস সংস্কারপন্থী অস্ত্রধারীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে ভান্তেরা। তাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে জুম্মুল্যান্ড গঠনের।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জুম্মুল্যান্ড গঠন করার জন্য রূপরেখাও তৈরি করা হয়েছে। কি ধরনের সরকার হবে পাহাড়ে তারও একটি ছক সাজানো হয়েছে। পাহাড়কে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে যে, বাংলাদেশ সরকার থেকে পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করে নিজেরাই সরকার গঠন করে স্বাধীন জুম্মুল্যান্ড গঠন করবে তারা। এ ধরনের তৎপরতাকে সরকার প্রশ্রয় না দেয়ায় পার্বত্য জেলাগুলোতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, ‘৯৬৯’-এর সদস্যরা শুধু মিয়ানমার নয়, বাংলাদেশসহ সকল বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যাদের মূল টার্গেট হলো মুসলমান। মিয়ানমারের মুসলমানদের ওপর হামলায় উস্কে দেয় ভান্তেরা। তারা নিধনযজ্ঞে অংশগ্রহণও করে। জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে যে চিত্র লক্ষ্য করা গেল তা শুধু ভয়াবহ নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকিস্বরূপ। শুধু সরকার নয়, সবারই এ ক্ষেত্রে সঙ্গত ভূমিকা পালন প্রয়োজন।

 

http://www.dailysangram.com/post/281528-