৮ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ১১:৩১

পাচারকারীদের ক্রান্তিকাল

-ইবনে নূরুল হুদা


বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র ভিসানীতি ঘোষণা হওয়ার পর বিষয়টিকে সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষই নিজেদের বিজয় হিসাবে উল্লেখ করে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞমহল মনে করছেন, নতুন এই ভিসানীতি যে পক্ষেরই অনুকূল বা প্রতিকূলে যাক না কেন জাতি হিসাবে আমরা কিন্তু ঠিকই হেরে গেছি। যে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলাম স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও আমরা সে গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারিনি বরং আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে নিজ কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার জন্য বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। জাতি হিসাবে এরচেয়ে বড় লজ্জার আর কী হতে পারে? অথচ আমাদের দেশের একশ্রেণির রাজনীতিবিদ বিষয়টি উপলব্ধিই করতে পারছেন না।
নতুন ভিসানীতি নিজেদের জন্য পোয়াবারো বলেই প্রচারণা চালিয়েছে সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষই। এমনকি এই বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আস্ফালন করতেও দেখা গেছে। কিন্তু বিষয়টি ক্রমেই ফুটা বেলুনে পরিণত হতে চলেছে। ইতোমধ্যেই সরকার পক্ষ তাদের গোঁফ নামাতে শুরু করেছে। এমনকি মার্কিন এই ভিসানীতির বিরুদ্ধে সরকার দলীয় সমর্থক একজন প্রবাসী মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমত মামলাও ঠুকে দিয়েছেন। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় নতুন এই ভিসানীতি নিয়ে সরকারপক্ষ বেশ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই রয়েছে।

অভিজ্ঞমহল থেকে মনে করা হচ্ছে, মার্কিন এই নতুন ভিসানীতি বেশ সুদূরপ্রসারী। এর প্রভাবও হবে সর্বব্যাপী। পক্ষবিশেষে বিষয়টিকে যতই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হোক না কেন বাস্তবতা কিন্তু বেশ ভিন্ন। অবশ্য ইতোমধ্যেই ভিসানীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ ধরনের খবরই প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা গেছে, নতুন ভিসানীতির কারণে প্রথমেই বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে দেশ থেকে অবৈধভাবে বিদেশে অর্থপাচারকারীরা। তাদের বেশ ক্রান্তিকালই শুরু হয়েছে। ফলে অর্থপাচারকারীদের মধ্যে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তারা এখন নিজেদের পাচারকৃত অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় অংকের অর্থ গচ্ছিত রাখা এখন আর নিরাপদ মনে করছেন না ধনাঢ্য বাংলাদেশী ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মালিকরা।

মার্কিন প্রভাববলয়ের পশ্চিমা দেশগুলো নিয়েও তাদের ভরসা এখন বেশ তলানিতে। এর মধ্যেই আবার চলতি বছরের শুরু থেকেই বিদেশীদের জন্য প্রপার্টিতে বিনিয়োগ কঠিন করে তুলেছে কানাডাও। তীব্র গোপনীয়তার নীতির কারণে বিশ্ববাসীর কাছে গোপন অর্থ সঞ্চয়ের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিচিত সুইজারল্যান্ড। এখন নিরাপত্তাহীনতার কারণে সেখান থেকেও বিনিয়োগ সরিয়ে আনছেন বিনিয়োগকারীরা। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত এক বছরে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ। গ্রাহকের গোপনীয়তার নীতির কঠোর অনুসরণ সত্ত্বেও পশ্চিমা বলয়ের দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ডকেও এখন আর নিরাপদ ভাবছেন না সেখানে গোপনে অর্থ গচ্ছিত রাখা বাংলাদেশীরা।

সংশ্লিষ্টদের সন্দেহ, এসব দেশে পাচারকৃত অর্থ এখন তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভানিয়া ইত্যাদির মতো পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে সরিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু এতেও তারা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। সরকারি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ব্যাংক খাতের নির্বাহীসহ বিভিন্ন খাতের দুর্নীতিগ্রস্তদের অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তুলনামূলক কম। আবার পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর আর্থিক খাতের অপরাধ শনাক্ত বা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ডাবলিনভিত্তিক আর্থিক অপরাধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এএমএল ইন্টেলিজেন্সের ভাষ্যমতে, ইউরোপ মহাদেশের অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের অন্যতম প্রধান করিডোর হিসেবে পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের নাম বারবার সামনে এসেছে। বিভিন্ন সময় নানা মাত্রার আর্থিক অপরাধের তথ্য উদ্ঘাটন এ অঞ্চলে অর্থ পাচারের সমস্যার মাত্রাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

পানামা ও প্যান্ডোরা পেপার্সের মতো ফাঁস হওয়া নানা নথিপত্রে জটিল করপোরেট কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে অফশোর বিনিয়োগের নামে অবৈধ অর্থ পাচারের তথ্য এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া ট্রেড ইনভয়েসিং জালিয়াতি, ফ্রি ট্রেড জোন ও বৈদেশিক বাণিজ্য, ভুয়া ফাউন্ডেশন, প্রপার্টি খাতে বিনিয়োগ, বেসরকারি বিনিয়োগ তহবিলসহ নানা পন্থায় অর্থ পাচার ঘটে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলো হুন্ডিকে চিহ্নিত করেছে অর্থ পাচারের বড় উপায় হিসেবে। জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ভাষ্যমতে, মোটা দাগে অর্থ পাচারের উৎস মূলত তিনটি। দুর্নীতি, অপরাধমূলক কার্যক্রম ও করপোরেট কর ফাঁকি। এর মধ্যে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির আওতাধীন মোট অর্থের পরিমাণ থাকে সার্বিক বৈশ্বিক জিডিপির ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের বৈশ্বিক জিডিপির হিসাব (১০৩ ট্রিলিয়ন) আমলে নিলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৫ ট্রিলিয়ন (৫ লাখ কোটি) ডলারেরও বেশি।

এছাড়া সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক অপরাধের মাধ্যমে প্রতি বছর জড়োকৃত অর্থের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন (২ লাখ কোটি ডলার)। এছাড়া প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থের বড় একটি অংশ লেনদেন হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচারকারীদের হাত ধরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত মুদ্রার নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে জড়িতরা এখন আর্থিক খাতের সুশাসন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, এমন স্থানকে বেছে নিচ্ছে। সে হিসেবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সরিয়ে নেয়া অর্থের গন্তব্য হিসেবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি হয়ে উঠেছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। আবার সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী বিনিয়োগ স্থানান্তরের তথ্য সামনে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুইস ব্যাংকগুলোয় এখন আর আগের মতো ঢালাওভাবে অর্থ রাখা যাচ্ছে না। এখন তারা কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ আসছে তা প্রকাশ করা শুরু করেছে। পাচারকারীরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে সুইস ব্যাংক হয়তো গ্রাহকের নামও প্রকাশ শুরু করবে। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও এখন ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে পাচারকারীরা সুইস ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যেসব দেশে ব্যাংক খাত বা সুশাসন ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সেসব দেশে অর্থ স্থানান্তর করছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবার ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এ গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২৭ কোটি ডলার। ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত এ গড়ের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।
বারবুডা, কেম্যান আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশগুলোয়ও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের তথ্য শুনতে পাওয়া যায়। অতীতেও পানামা পেপার্স ও প্যান্ডোরা পেপার্স নথিতে অফশোর বিনিয়োগে সহায়তা কোম্পানির সহযোগিতায় এমন কিছু দেশে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশীর তথ্য উঠে এসেছিল। আবার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকংয়ের মতো মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের (এশিয়ার সবচেয়ে পূর্বের দেশগুলো) দেশগুলোয়ও নতুন করে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এসব দেশে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের বিষয়টিকে আরো সতর্কভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। দেশগুলোয় এরই মধ্যে দ্বিতীয় নিবাস গড়ছেন বহু বাংলাদেশী। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের মালিক, মাঝারি ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারাও।

মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির কারণে সার্বিক পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে রেমিট্যান্সের বৃহত্তর উৎস ছিল সৌদি আরব। কিন্তু চলতি অর্থবছরে আকস্মিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আহরণ বেড়ে গেছে। মার্কিন সরকারের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান হওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ১ লাখ ৫২ হাজার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশী প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশীরা জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ করে দেশে ২ হাজার ডলার করে পাঠানো সিংহভাগ প্রবাসী বাংলাদেশীর পক্ষে অসম্ভব। আবার বাংলাদেশীদের বড় একটি অংশ সেখানে অবস্থান করছেন মূলত শিক্ষার্থী হিসেবে। তাদের পক্ষেও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ও বসবাসের খরচ বহন করে দেশে এত বিপুল অংকের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রবাহ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কেউ কেউ বিষয়টিতে সন্দেহ প্রকাশ করে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, দেশটি থেকে পাচারকৃত অর্থই এখন রেমিট্যান্স আকারে ফিরিয়ে আনা বা স্থানান্তর করা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ ও ভিসানীতি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কূটনীতিকরাও বলছেন, মার্কিন বিধিনিষেধ বা ভিসানীতির প্রভাব অনেক সুদূরপ্রবাসী। শুধু আওতাধীন বা সংশ্লিষ্টদের পরেই এর প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে না। এ কারণে অর্থ পাচারকারীরাও এখন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোয় বিনিয়োগ বা অর্থ গচ্ছিত রাখাকে নিরাপদ বলে মনে করছেন না। ফলে তাদের অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

বরাবরই মার্কিন মিত্র বা প্রভাববলয়ের আওতাভুক্ত পশ্চিমা দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বিধিনিষেধ নীতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে। এ বিষয়টিও পাচারকারীদের অর্থ স্থানান্তর সিদ্ধান্তে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এক সময় নিছক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি থাকলেও এখন প্রকাশ্য ও গোপন লগ্নির কেন্দ্র হিসেবে দুবাইয়ের নাম সামনে আসছে বারবার। দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাই থেকে ব্যবসা চালাচ্ছে। আকর্ষণীয় মুনাফার খোঁজে আরব আমিরাতের রিয়েল এস্টেট ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায়ও নাম লেখাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। দেশটিও এখন যেকোনোভাবে হোক বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। এজন্য বিদেশী ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। পাচারকারীরা সে সুযোগও গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলেফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে গোল্ডেন ভিসা চালু করে ইউএই। এ সুযোগ লুফে নিয়ে ব্যাংক পরিচালক, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসা নিয়েছেন। দুবাইয়ের এ গোল্ড কার্ডধারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই সেখানে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ সংশ্লিষ্টদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে আবারো অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আবার গন্তব্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত দূরপ্রাচ্যের (এশিয়ার পূর্বতম প্রান্ত) দেশগুলোয়ও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে বাংলাদেশীদের নতুন বিনিয়োগ নিয়ে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম বড় রুট হলো সিঙ্গাপুর। বৈশ্বিক আর্থিক গোপনীয়তার সূচকে দেশটির অবস্থান এখন তৃতীয়। এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর এ আর্থিক ও বাণিজ্যিক রুটের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেখানে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মূলত আমদানি-রফতানি বাণিজ্যই সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বস্ত্র ও পোশাক খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খাতটির অনেক ব্যবসায়ীকে নিয়মিতভাবেই সেখানে আসা-যাওয়া করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের কেউ কেউ সেখানে অর্থ স্থানান্তর করছেন।

সিঙ্গাপুরের মতোই পাচারকৃত অর্থের আরেক আকর্ষণীয় গন্তব্য মালয়েশিয়া। নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিদেশীদের বিনিয়োগ কোটায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে দেশটি। বিশেষ করে ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ বা এমএম২এইচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশটিতে অভিবাসনের জন্য আবেদনের সংখ্যা এখন বাড়ছে। এ কর্মসূচির আওতায় আবেদন করতে হলে আবেদনকারীকে লিকুইড অ্যাসেট বা তরল সম্পদ (নগদ অর্থ, ব্যাংকে জমা বা সহজে নগদায়নযোগ্য বিনিয়োগ) দেখাতে হয় কমপক্ষে ১৫ লাখ রিঙ্গিতের সমপরিমাণ। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী তা ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার কিছু বেশি (১ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ২৩ টাকা ১৩ পয়সা)। এছাড়া মাসিক আয় দেখাতে হয় অন্তত ৪০ হাজার রিঙ্গিতের সমপরিমাণ (৯ লাখ ২৫ হাজার টাকার কিছু বেশি)। মূলত ধনাঢ্য বিদেশীদের মালয়েশিয়ায় অবস্থানের সুযোগ করে দিতে প্রোগ্রামটি চালু করা হয়েছে বলে দেশটির সরকারি ওয়েবসাইটের তথ্যে উঠে এসেছে। পাচারকৃত টাকা রেমিট্যান্স হয়ে ফিরছে কিনা সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য হলো, ‘আমাদের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। আমরা দেখছি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। বৈধ চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সকে আমরা সব সময়ই স্বাগত জানাই।’

সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, নতুন মার্কিন ভিসানীতির বলী হতে যাচ্ছেন দেশ থেকে অবৈধভাবে বিদেশে অর্থপাচারকারী রথী-মহারথীরা। তারা এখন বেশ অস্থিরতার মধ্যেই রয়েছেন। আর এদের অধিকাংশ হচ্ছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। যারা এতোদিন মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে নানাভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এসেছেন তারাই এখন এই নীতির প্রথম ভিক্টিম। কারণ, বিদেশে অর্থপাচার করে নিরাপদ মনে করলেও সে আশায় এখন গুঁড়ে বালি পড়তে শুরু করেছে। তারা এখন নিজেদের গচ্ছিত অর্থের নিরাপত্তা নিয়েই রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা সে অর্থ কোথাও স্থানান্তর করে খুব একটা স্বস্তিবোধ করছেন না।

এমতাবস্থায় এসব পাচারকারীর উচিত দেশের টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে নিজেদেরকে কলঙ্কমুক্ত করে জাতির এই ক্রান্তিকালে সঠিক দায়িত্ব পালন করা। অন্যথায় জাতি তাদেরকে গণদুশমন হিসাবেই চিহ্নিত করবে!

https://dailysangram.info/post/529313