৭ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৪২

পানিতে ডুবে কচি প্রাণের মৃত্যু চলছেই

পটুয়াখালীর কলাপাড়া শহর থেকে পূর্বদিকে দেড় কিলোমিটার গেলেই আন্ধারমানিক। নদীর পাড় ঘেঁষে মিনিট দশেক হাঁটলে ডান পাশে দক্ষিণ ইটবাড়িয়া গ্রামের জিয়া কলোনি। এখানে ভূমিহীন ছিন্নমূল মানুষের বাস। নদীর জোয়ার-ভাটা কলোনির বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। দূরন্ত শিশুরা দল বেঁধে দাপিয়ে বেড়ায় নদীর জলে। মর্মন্তুদ এক ঘটনার পর এ গ্রামের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। যে পানিতে আনন্দে মাতত শিশুরা, সেই পানি নিয়েই এখন ভয়। কলাপাড়ার জিয়া কলোনিতে একটি অসহায় পরিবারের সাঁতার না জানা তিন শিশু পানিতে ডুবে লাশ হয়েছে।

অভাব-অনটনের সংসারে মা-হারা চার নাতি-নাতনিকে আগলে রাখছিলেন দাদি। প্রিয় নাতি-নাতনিকে হারিয়ে দাদি শেফালি বেগম এখনও ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। গত ১২ মে বাড়ির পাশে খেলা করছিল তিন শিশু মরিয়ম বেগম (৮), আল আমিন (৮) ও শারমিন আক্তার (৬)। খেলতে খেলতে দুপুর হয়ে যাওয়ায় গোসল করতে তিন শিশু নেমে যায় রাস্তার ধারের জমিতে জমে থাকা পানিতে। আর সেখানেই ডুবে মারা যায় তিন শিশু।

উপকূলের কলাপাড়ার মতোই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এমন মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, এবার ঈদুল আজহার ছুটিতে শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এক সপ্তাহে ২৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার নোয়াখালীতে এক দিনে পানিতে ডুবে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়। সন্তানহারা মায়েদের চোখে এখন জল আর বুকজুড়ে এক নদী দুঃখ। পানিতে তলিয়ে গেছে বেঁচে থাকার একমাত্র স্বপ্ন। ছোট্ট শিশুর ছিল কত আবদার, কত আহ্লাদ, দুষ্টুমিভরা দিনও– সবই এখন থমকে যাওয়া স্মৃতি। সংক্রামক রোগ ও দুর্ঘটনাজনিত কারণের বাইরে দেশে প্রতি বছর যত শিশু মারা যায়, এর অন্যতম পানিতে ডুবে মৃত্যু। তিন বছরে এই প্রাণহানি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। সরকারি হিসাবেই দেখা গেছে, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এখন পানিতে ডুবে মৃত্যু। গত তিন বছরে এ হার দ্বিগুণেরও বেশি। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে দেখা গেছে, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হয় পানিতে ডুবে।

গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। সংগঠনটির হিসাবে ২০২০ থেকে ২০২২– এই তিন বছরে পানিতে ডুবে ৩ হাজার ২৮৫ জন মারা গেছে, এর ৮৭ দশমিক ২৯ শতাংশই শিশু। গত জুনেই পানিতে ডুবে ৯৮ জন মারা গেছে। বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করেন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, পানিতে ডুবে প্রতিবছর পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর বড় অংশের খবর গণমাধ্যমে আসে না।’ দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশে (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়, যাদের ৩০ জনেরই বয়স পাঁচ বছরের কম।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) কমিউনিকেশন ম্যানেজার সারোয়ার ই আলম বলেন, বাংলাদেশে প্রতিদিন পানিতে ডুবে চার বছরের কম বয়সী ৩০ শিশু মারা যায়। ১ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু মারা যায় ৪০ জন। সব মিলিয়ে ১ থেকে ১৮ বছরের ৫০ শিশু প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যায়। ২০২১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং পানিতে ডুবে মৃত্যুকে ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুহার কমাতে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকে এসডিজির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেখানে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ গুরুত্ব পায়নি। ফলে অসুস্থতাজনিত কারণে শিশু মৃত্যুর হার কমে গেলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার আগের মতোই আছে। এমন মৃত্যু রোধে সরকার গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। তবে এক বছরের বেশি সময় পার হলেও এর অগ্রগতি নেই। চলছে বর্ষা, গ্রামগঞ্জ পানিতে টইটম্বুর। সামনে বন্যার শঙ্কা। এ সময়ই সাধারণত ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশবিষয়ক (ইসিডি) বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্পের পরামর্শক মো. তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ের পরিচালনার জন্য ৩৬০টি এনজিও আবেদন জমা দিয়েছে। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। খুব দ্রুত এনজিওর কার্যক্রম শুরু হবে। ১৬ জেলায় ১৬ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।’

সমষ্টির পরিচালক মীর মাসরুর জামান বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রধান কারণ, দিনের একটি সময় তারা মা-বাবার তত্ত্বাবধানে থাকে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকা নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা-পুকুরে বেষ্টিত হওয়ায় শিশুরা অসাবধানতায় এসব জলাশয়ে ডুবে যায়। ছোট-বড় সবার ক্ষেত্রেই পানিতে ডুবে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে সাঁতার শেখার কোনো ব্যবস্থা না থাকাকে ধরা হয়। অন্তত বর্ষার তিন-চার মাস অভিভাবকদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নিয়ে সচতেনতা তৈরি করা গেলে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব।

https://samakal.com/bangladesh/article/2307181887