২৭ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৩২

যাকে ব্যবহার করা যায় তাকে আস্থায় নেয়া যায় না

বিবিধ প্রসঙ্গ

|| মাসুদ মজুমদার ||


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভুটান সফর নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। এর কারণ ভুটান ভারতের প্রভাব বলয়ের মধ্যেই রয়েছে। আমাদের কোনো কোনো উপজেলার লোকসংখ্যা ভুটানের চেয়ে বেশি। কিন্তু ভুটান সম্পদশালী দেশ। পড়শিদের উপকার করতে পারে। ক্ষতি করার সক্ষমতা কম। আমাদের চাওয়া-পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ নয়। তা ছাড়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে তেমন কোনো ফাটলও নেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বও নেই। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, পর্যালোচনা চলবে আরো বেশ কিছু দিন। এই সফরের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আগামী নির্বাচনকেও প্রভাবিত করবে। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের ভারত নীতি জনগণ ইতিবাচকভাবে নেয়নি। জনগণের মনের মধ্যে ভারতীয় আচরণে প্রচুর ক্ষোভের বরফ জমাট বেঁধেছে। সেই ক্ষেত্রে মোদি সরকার চাইবে, যাচ্ছেতাই একটা চুক্তি ধরিয়ে দিয়ে জনগণের মন থেকে ভারতবৈরী মানসিকতায় একটু জল ঢেলে বন্ধুত্বকে উৎরে দিতে। তিস্তার পানি কূটনীতির ফসল হিসেবে গজলডোবায় পানি মেপে দায়হীন একটা কিছু করা হয়ে যেতে পারে। তিস্তার পানির চার ভাগের তিন ভাগ গজলডোবায় আসার আগেই ভারত কম করে হলেও বড় চারটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে তুলে নেয়। অবশিষ্ট এক ভাগ পানিতে আমাদের ‘কিউসেক’ ভিজবে না। পদ্মার পানি মাপা নিয়ে কৃষক মন্তব্য করেছিলেন, ভারত যে পানি দেয় তাতে তার ‘ইয়ে’ ভিজবে না। ‘ইয়ে’ বোঝাতে শালীন কৃষক ‘কিউসেক’ শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন ব্যঙ্গ করে। তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ এখনো অন্ধকারে। তাই চুক্তিতে আমাদের মন ভরানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা ভালো। অর্থহীন চুক্তির ফলাফল গঙ্গা-ফারাক্কার চেয়েও খারাপ হবে। চুক্তি হবে, পানি আসবে না। এ ব্যাপারে অভিন্ন অর্ধশতের বেশি নদীর পানি নিয়ে আমাদের প্রাপ্য হিস্যা গবেষণানির্ভর হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের কপাল মন্দের একটি বড় কারণ, দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রহী ছিলেন না। তার দল ও কার্যত ম্যান্ডেটহীন সরকারকে উপস্থাপন করে চুক্তি ও সফরের সবটুকু কৃতিত্ব তিনি নিতে চেয়েছিলেন বলেই মনে হয়। দুনিয়াজুড়ে নিয়ম হচ্ছেÑ যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকার বিদেশে বিরোধী দল ও জনগণের দোহাই দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে একটি কার্যকর ও সক্ষম বিরোধী দল দেশ ও জাতির অতন্দ্র প্রহরীর মতো অবস্থান নেয়। তাতে সরকার বিদেশী চাপ মোকাবেলার একটা ‘ভালো অজুহাত’ পায়। এ ছাড়া জনগণকেই বার্গেনিং শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, শেখ হাসিনা যদি বলতেন, আমার দেশের জনগণ পানির জন্য উদগ্রীব, দেশের উত্তর জনপদ মরুভূমিতে রূপ নিচ্ছে, পানি ছাড়া অন্য চুক্তি জনগণ মেনে নেবে না, তখন ভারত সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হতো। আমাদের দুর্ভাগ্য রওশন ও এরশাদ শুধু সংসদীয় রাজনীতির কলঙ্ক ও লজ্জার উদাহরণ হয়ে রইলেন না, সেই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় ক্ষতিকর প্রমাণিত হলেন। রওশন ও এরশাদ যেহেতু ‘গৃহপালিত’ ও অনুগত বিরোধী দলÑ প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যাওয়ার আগে তাদেরকে দিয়ে কিছু সভা-সমাবেশ করিয়ে পানির জন্য কান্নাকাটি করাতে পারতেন। ভারত এবং আমাদের সবার জানা ছিল, তারা পুতুল খেলার বিরোধী দল। বিএনপি যা করেছে, আক্ষরিক অর্থেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় পার্টি টুঁ শব্দটিও করল না। কেন করল না?
শিল্পী কামরুল হাসান ‘বিশ্ববেহায়া’র কার্টুন এঁকে এরশাদের রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। সেটা তার রাজনৈতিক শ্রেণী চরিত্র বোঝানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। ব্যক্তি এরশাদ হয়তো সংবেদনশীল মানুষ। কবিও বটে! তার অনেক গুণও থাকা সম্ভব। কিন্তু রাজনীতির বাইরের এরশাদ আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নন। রওশন কখনো রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। স্বৈরশাসনের আমলে তিনি ‘ফার্স্ট লেডি’ হয়ে উঠেছিলেন। তখন এরশাদ রাজার মতো রাজ্য শাসন করেছেনÑ ‘রাজারে শাসন করেছেন রানী।’ কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয় ’৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জামায়াত জনগণকে রাজপথে রেখে এরশাদের ‘এক হুমকিতেই’ ভাগ-বাটোয়ারার নির্বাচনে অংশ নিলো। এর মাধ্যমে এরশাদ বৈধতার ডুগডুগি বাজালেন। শেষ রক্ষা হলো না। আওয়ামী লীগ-জামায়াতকে আবার রাজপথে এসে জনগণের সাথে যোগ দিতে হলো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারতের দূতিয়ালিতে এরশাদ একইভাবে ভাড়াটের মতোই আচরণ করলেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের অবস্থান ওলট-পালট হয়ে যায়। এর পর থেকে এরশাদ সব সময় মামলার ঝুঁকি নিয়ে বি টিমে খেলে যাচ্ছেন। তার রাজনৈতিক ভাবনা বিএনপির মতো। সখ্য আওয়ামী লীগের সাথে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই বেশি মাত্রায় ভারত-লবির হাতে ব্যবহৃত হয়েছেন। সর্বশেষ, ১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারতের দৃশ্যমান তাঁবেদারের ভূমিকায় নামলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি সব সময় কিছু গণভিত্তি পায়। সেটাকে পুঁজি করে কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো এরশাদ সব সময় আনফেয়ার খেলেছেন। ডাবল অ্যাকটিং করার চেষ্টা করেছেন। ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন অবিশ্বস্ত রাজনীতির মধ্যমাঠের খেলোয়াড়। এমন রাজনীতির মানুষকে ব্যবহার করা যায়, আস্থায় নেয়া যায় না।
পৃথিবীতে মানুষ তাকেই দাম দেয় যার ক্রয়ক্ষমতা বেশি অথবা যার বার্গেনিং ক্ষমতা অবজ্ঞা করা সম্ভব হয় না। শক্তিতন্ত্রও এ দু’টিকে সমীহ করে চলে। হ্যাঁ, পারচেইজিং পাওয়ার ও বার্গেনিং পাওয়ার শক্তিধরদের বেশি থাকা সম্ভব। তারপরও জনগণের ক্ষমতা অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী জনমতকে হয়তো অবজ্ঞা করেননি; কিন্তু যুৎসই কাজেও লাগাতে পারেননি। তাই তার ভারত সফর কার্যত ফল বয়ে আনেনি। উল্টো, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে যেটুকু দৃঢ়তা প্রদর্শনের ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, সেটা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। উপরন্তু তার বন্ধুত্বের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছেছে ভারতের প্রতি যুক্তিহীন একতরফা আচরণ হিসেবে, যা জনগণের কাছে সম্মানের বিষয় মনে হয়নি। অপর দিকে, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী দিল্লির দরবারে গুরুত্ব পেলেন পশ্চিম বাংলা ও তার জনগণের দোহাই দিয়ে। তার ভূমিকায় আমরা ুব্ধ হতে পারি; কিন্তু এটা কি অস্বীকার করতে পারি, তিনি দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করেছেন।
masud2151@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215384