৭ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৩৩

বাজারে অসহায় মানুষ

ঢাকার বাজারে কাঁচা মরিচের আকাশছোঁয়া দামের রেশ শেষ হয়নি। এরমধ্যে আবারো বাড়তে শুরু করেছে পিয়াজের দাম। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র একটা করে পণ্য ধরে ধরে পকেট কাটছে ভোক্তা সাধারণের। এভাবে দফায় দফায় বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে অনেক আগেই। নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। বিপরীতে বাড়েনি মানুষের আয়। অনেকেই বাধ্য হয়ে আয় ও ব্যয়ের মধ্য সমন্বয় করতে দৃশ্যত অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব খরচ কমিয়েছেন। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় খাবার উপকরণ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছেন ওএমএসের লাইনে।

এ ছাড়া খরচ কমাতে পরিবার-পরিজনকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ দিকে খাবার খরচ কমানোর ফলে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা। এতে বাড়ছে রোগ-বালাই।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না, এমন মানুষ যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশে এখন ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। বাংলাদেশের উপরে আছে ভারত, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও চীন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেয়ে পুষ্টিমান অর্জন করতে একটি বড় বাধা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে না পারা ।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছিল। এটা সত্য। কিন্তু এখন তো বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেছে। তবে দেশের বাজারে কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এটা দুঃখজনক। প্রায় সবারই আয় কমেছে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় থেমে থাকেনি। আয়ও বাড়েনি। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কঠোর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে সকালের দিকে ব্যবসায়ীরা কাঁচামরিচের প্রতি কেজি দাম চেয়েছেন ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজি। আর বিকাল বেলা প্রতি কেজি বিক্রি করছেন ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি’র) তথ্য বলছে, কাঁচামরিচ, পিয়াজ ও টমেটোসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এদিকে কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি রাখায় গত কয়েক দিনে সারা দেশে দুই শতাধিক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী কালাম মিয়া বলেন, আমদানি খরচ বেশি। এ ছাড়া ঈদের কারণে চাহিদা বেড়েছে, সেই তুলনায় মরিচের সরবরাহ নেই বললেই চলে। তাই বাজারে দামও বেশি। তিনি বলেন, ভারত থেকে সামান্য পরিমাণে মরিচ আমদানি হয়েছে। বৃষ্টির কারণে দেশি মরিচের সরবরাহ অনেক কম। এ কারণে দাম বেড়ে গেছে। অথচ ঈদের পরপরই মরিচের দাম পাইকারিতে ২০০ টাকায় নেমেছিল। এরপর মঙ্গলবার দাম কিছুটা বেড়ে ৩০০-৩৫০ টাকায় ওঠে। একদিনের ব্যবধানে এবার ৫০০ টাকা ছাড়িয়েছে কাঁচামরিচের কেজি।

বাজারে আসা সানজিদা পারুল বলেন, মরিচের দাম অনেক বেশি। দু’দিন আগে এক পোয়া কিনেছি ৬০ টাকায়। আজকে (গতকাল) বলছে এক পোয়া ১৪০ টাকা। এটা কীভাবে সম্ভব! দেশটা কি মগের মুল্লুক?

কাঁচামরিচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে টমেটোর দামও। বাজারে দু’দিন আগে টমেটো বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা কেজি, এখন ৩০০ টাকা। বিক্রেতারা বলেন, বাজারে দেশি টমেটো নেই। তাই দাম বেশি।

এ ছাড়া দেশের খুচরা বাজারে আবারো বাড়তে শুরু করেছে পিয়াজের দাম। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। আমদানিকৃত পিয়াজের দাম বেড়েছে ৫ টাকা।

টিসিবি তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকায়। সেটি বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। টিসিবি আরও বলছে, আমদানিকৃত প্রতি কেজি পিয়াজ ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে তা ৩৫-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আর ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব কনজ্যুমার অ্যাফেয়ার্সের তথ্য অনুসারে, প্রতি কেজি পিয়াজ ২৫ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম ছিল ২০ রুপি।

এদিকে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজধানীসহ সারা দেশে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এতে দাম বেশি রাখায় প্রায় দুই শতাধিক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

কাওরান বাজারের মাছের দোকানে দোকানে ঘুরছেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ। দোকানিকে জিজ্ঞেস করছেন বিভিন্ন মাছের দাম। ৫টি দোকান ঘুরে ৬ নম্বর দোকানে গিয়ে কিনলেন ১ কেজি টেংরা মাছ। পরে আরও ৪টি দোকান ঘুরে একটা রুই মাছ কেনেন তিনি। এবার পাশেই থাকা মাংসের দোকান ৮০০ টাকা দিয়ে ১ কেজি গরুর মাংস কেনেন। মাংসের দোকানের সামনে ওই লোকের সঙ্গে কথা হয়। তার নাম খালেক। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন বাংলামোটর এলাকায়। ছেলে অষ্টম এবং মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তিনি জানান, প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরো মাসের জন্য মাছ-মাংস কেনেন।

পরিচয় দেন তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী। যা বেতন পান তার প্রায় অর্ধেক খরচ হয় বাসা ভাড়ায়। তারা ৩ রুমের বাসায় থাকতেন। খরচ বেড়ে যাওয়ায় ১টি রুম সাবলেট দিয়েছেন। খালেক বলেন, সমস্যা যতই হোক, খাওয়া তো বাদ দেয়া যাবে না। গত বছর যে পরিমাণ মাছ-মাংস কিনতে পারতাম, এখন তা পারি না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। আমার বেতনের পুরো টাকা শেষ হয়ে যায়। স্ত্রীকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেয়াসহ সাংসারিক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কোনো চাকরি করতে পারে না। তবে অনলাইনে কিছু ব্যবসা শুরু করেছে। সেখান থেকে অল্পকিছু আয় হয়। এভাবেই টেনেটুনে চলছি। তিনি বলেন, বাজারের এই অবস্থা চলতে থাকলে ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে গ্রামে পাঠাতে হবে। কারণ অসৎভাবে তো চলতে পারি না। আর টাকাও জমা করতে পারি না। যা কিছু জমা ছিল, সেগুলোও শেষ হয়ে গেছে। উল্টো কিছু টাকা ঋণ হয়েছে।
মগবাজার নয়াটোলা এলাকার বাসিন্দা নাজমুল দীর্ঘদিন ধরে একটি চায়ের দোকান চালান। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। আগের মতো সংসার চালাতে পারছেন না তিনি। এমন কি আগের সঞ্চয় ভেঙ্গে সংসারের জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি জানান, আগে মাসে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন মাসে ১০ হাজারো থাকছে না। এই আয় দিয়ে ঢাকায় সংসার চালানো কঠিন। ছেলেমেয়ে একটু মাংস খেতে চাইলেও কিনতে পারি না। বাধ্য হয়ে দোকান বাদ দিয়ে টিসিবি’র ট্রাক থেকে চাল-আটা কিনি। ফার্মের (ব্রয়লার) মুরগির দামও ২০০ টাকা কেজি। এই ফার্মের মুরগিও কেনার সামর্থ্য নাই। এতে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।

কথা হয় রিকশাচালক খোকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে সকালে ২০ টাকা দিয়ে ২ পরোটা ও সবজি পাওয়া যেত, এখন ৪০ টাকার বেশি লাগে। ভাতের প্লেট ১৫ টাকার নিচে নাই। বেশি ভাড়া চাইলে মানুষ দিতে চায় না। আয় তো বাড়েনি। খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। আমাদের কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই। দেশের নাকি উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু আমাদের তো কষ্ট বাড়ছে। তিনি বলেন, আগে দেরি করে বের হলেই চলতো। কিন্তু এখন কিছু টাকা বেশি আয়ের জন্য ঘর থেকে আগে আগে বের হন তিনি। তার আয়ে পুরো পরিবার চলে। কয়েক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক দফা বাড়ায় চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। খোকন বলেন, সারা দিন রিকশা চালিয়ে যখন বাজারে যাই, তখন চোখে পানি চলে আসে। সারা দিনে যা আয় হয় তার মধ্যে রিকশার গ্যারেজ ভাড়া দিতে হয়। সারা দিন রাস্তায় থাকলে চা-বিড়ি খেতে কিছু খরচ হয়। দিন শেষে ৫০০ টাকাও হাতে থাকে না। এই টাকা দিয়ে শাকসবজি কিনবো নাকি চাল ও ডাল কিনবো? কাজ শেষে যাওয়ার সময় রাস্তায় কম দামে যে সবজি পাই তাই কিনি। মাছ-মাংসের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাছ-মাংস কেমনে কিনবো?

আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা সবাই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, খরচের সঙ্গে আয়ের ভারসাম্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসারে অভাব ছাড়ছেই না। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যে যাদের আয় কম তারাই সবচেয়ে কষ্টে আছেন।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ। দুই শ্রেণির মানুষ আয় দিয়ে পরিবারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে।

বাজারদরের চিত্র: বাজারের সবচেয়ে সস্তা পাঙ্গাশ মাছের দামও বেড়েছে। এক কেজি ওজন বা মাঝারি আকারের পাঙ্গাশ ২০০ টাকা আর বড় পাঙ্গাশ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকার উপরে। রুই-কাতলা মাছ আকারভেদে ৩০০-৪২০ টাকা, কালবাউশ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি, শিং, মাগুর ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, টেংরা ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, আইড় মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। চাষের কই মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। তেলাপিয়া ২০০-২৫০ টাকা। ঢাকার বাজারগুলোতে বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, করলা ১২০, কচুরমুখি ১০০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা। পেঁপে ৫০, গাজর ১২০, আর আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়।

রাজধানীর বাজারগুলোতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ডিমের দাম। এক ডজন ফার্মের মুরগির ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। এ ছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায় আর খাসির মাংসের কেজি ১১০০ টাকা।

https://mzamin.com/news.php?news=63424