৭ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ১১:০৬

বাঘ আসিয়াছে

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

রাখাল বালকেরা বনের পাশে ভেড়া চড়ায়। সন্দেহ নেই কাজটি খুবই একঘেয়ে। এর মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। তার ভেতরেও বিনোদনের সন্ধান করে এক রাখাল। বনের ধারে এসে সে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘বাঘ আসিয়াছে’। অন্য রাখাল এবং সাধারণ মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে বাঘ তাড়াতে ছুটে আসে। আর তখন রাখাল বালক হেসে কুটি কুটি। এভাবেই বাঘ আসিয়াছে বলে সে একটা আনন্দের উপসর্গ খোঁজে। কিন্তু বাঘ আসে না। এভাবে ধোঁকা দিতে দিতে এক সময় তার কণ্ঠে বাঘ আসিয়াছে শুনলেই আর কেউ এগিয়ে আসে না। কেউ তার চিৎকারে বিশ্বাস করে না। এভাবে একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এসে পড়ল। কিন্তু সেদিন তাকে রক্ষার জন্য কেউ আর এগিয়ে এলো না। বাঘ রাখাল বালককে পর্যুদস্ত করে বনের ভেতরে চলে গেল।

এ রকম বাঘের গল্প বলেছেন, দুষ্ট রাখাল রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। এরা দুইজনেই এক সময় আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন। রাশেদ খান মেননের তো এখন আর চরিত্র বলে কিছু নেই। হাসানুল হক ইনু শেখ মুজিব হত্যার অন্যতম রূপকারও বটেন। সর্বশেষ যখন এদের দু’জনকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন করলেন, তখন এই দুইজন ছুঁড়ে ফেলে দেয়া মন্ত্রীর সে যে কী আফসোস। হাসানুল হক ইনু তো এক পয়সার এক তত্ত্ব বের করলেন। তিনি বললেন, তাকে বাদ দিয়ে সরকার তার কোনো সম্পূর্ণতা নেই। তার এক পয়সার দল যুক্ত হলেই কেবল সরকার সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে। কী বেহায়া উক্তি! মন্ত্রিত্ব নেই। গাড়িতে পতাকা নেই। সামনে পেছনে মৌমাছির ঝাঁক নেই।

ইনু সাহেবের কেমন যেন খালি খালি লাগে। তিনি যে চেৎনাবাজ সরকারের শরিক হতে পারেননি। তাই নিয়ে তাদের আফসোসের সীমা নেই। তার সঙ্গে যোগ দেন রাশেদ খান মেনন। প্রধানমন্ত্রিত্ব যেমন মজার, মন্ত্রিত্বও তেমন মজার। মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ায় যেন তাদের পাখাকাটা যায়। ফলে সেই মন্ত্রিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য কত রকম তেলবাজি যে এই দুই চেৎনাবাজ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। সম্প্রতি, জাতীয় সংসদে এই দুইজন বলে বসলেন যে, গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ইস্যু নয়। প্রকৃতপক্ষে, তারা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান এবং এখানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলতে চান।

এ রকম কথা এর আগে কেউ কোনোদিন বলেনি। ফলে এই ঘটনা ছিল চমকে দেয়ার মতো। এদের কথার সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে যদি সেন্ট মার্টিন দিয়ে দেয়া যায়, তাহলে চতুর্থ টার্মেও তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারেন। তিনি এ রকমও বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যে কাউকে ক্ষমতায় রাখতে পারে এবং যে কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এ কথা সত্য, ২০০৯ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মিলে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসীন করেছিল। ফলে শেখ হাসিনা ভাল করেই জানেন যে, শেখ হাসিনা চাইলে তারা সরকারে ওলটপালট করতে পারে। সেভাবেই তিনি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার চেয়ে ভাল আর কে জানে!

এইসব মিলিয়ে দেশে এখন ‘বাঘ আসিয়াছে’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে টিভি টকশোগুলোতে তুমুল আলোচনা। ছোট ছোট মুখে অনেক বড় বড় কথা আমরা শুনছি। এই সেন্ট মার্টিন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও অহংকার করে বলেছেন যে, ২০০১ সালে তার কাছে কারা যেন গ্যাস চেয়েছিল। তিনি দেশীয় সম্পদ কাউকে দিতে চান না। সেখান থেকে ২০০১ সালে তাকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, গ্যাস দেয়ার মুচলেকা দিয়ে বিএনপি নাকি ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু তন্ন তন্ন করে ঘেঁটেও এ কথার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি যদি গ্যাস দেয়ার চুক্তি করতেন, তাহলে ২০০১ সালেও তিনি ক্ষমতায় আসতে পারতেন। বিএনপি সে সময় গ্যাস দেয়ার মুচলেকা দিয়েছিল বলে এখন পর্যন্ত অভিযোগ করে যাচ্ছেন। অথচ আমরা দেখেছি, ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম ভারতে গ্যাস রফতানি শুরু করে। তাহলে, এত বড় বড় ফুটানির কথা কেন বলা হচ্ছে!

সেন্ট মার্টিন নিয়ে এখন যে ডামাডোল সে কথারই বা উৎস কী? কে, কখন, কোথায় সেন্ট মার্টিন ইজারা চেয়েছিল এমন কথা শোনা যায়নি। মেনন বা ইনু সাহেব যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিন চায় বলে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিন চায় না। এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণœ হয় এমন কোনো কাজ যুক্তরাষ্ট করবে না। সেন্ট মার্টিন কে ইজারা চায় সেটা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এ রকম কোনো খবর তার জানা নেই। যে কথা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানেন না, সে কথা কোন্ জাদুবলে জেনে গেলেন আওয়ামী লীগের ‘এক পয়সার সহযোগী’ হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেনন।

বাংলাদেশে যদি নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি সুনিশ্চিত। নির্বাচনে হেরে গেলে আওয়ামী লীগ যাতে খরকুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে পারেন সেন্ট মার্টিন ইস্যু সে ব্যবস্থা করে রাখছে তারা আগেই। অর্থাৎ যা ঘটেনি বা যাকে ইস্যু করা হয়নি সে রকম একটা ঘটনা সামনে নিয়ে সরকারের ফেউ ইনু-মেনন ইট ফেলে রাখলেন। যদি তাদের এই চক্রান্তমূলক বক্তব্য সত্য হয়, তাহলে তাদের ভাগ্যের শিকা খুলতেও পারে। সেন্ট মার্টিন ইস্যুতে তাদের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সায় দেখে অনেকেই ভাবছেন, এবার এই দুইজন মন্ত্রিপরিষদে পুনর্বহাল হলেও হতে পারেন। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ইনু-মেনন একা এই ধোঁকার সৃষ্টি করেননি। তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও আছেন। এখন তিনজনে মিলেই শোরগোল তুলছে। কিন্তু উটপাখি রাজনীতি শেষ পর্যন্ত কতটুক সফল হবে, সেটা সরকার বিবেচনায় রাখলে ভাল করবে বলে মনে হয়।

আমরা বলতে চাইছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি চীন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বান্দরবানের একটি অংশ আলাদা করে নতুন দেশ গঠনের জন্য যুদ্ধ করছে। প্রথমদিকে সরকার এসব বিষয় গোপন রাখলেও এখন তা আর গোপন নেই। সরকার এর আগেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ জেএসএস-কে একেবারে রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়ে তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। সেই শান্তিচুক্তির ফলে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস এখন একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। দখল, চাদাবাজি, এগুলোই হচ্ছে তাদের মূল কাজ। এখানে সার্থের সংঘাত বেধেছে। জেএসএস এখন কুকি চীন লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে।

কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট সেখানে নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন করে সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। তারা বিদেশী মদদ ও অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং সেখানে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ফলে মাঝেমধ্যেই সেনাসদস্যদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। উপরন্তু, এসব জেলায় পর্যটন সম্ভাবনা ক্রমহ্রাসমান। এখন বলতে গেলে, পুরো বান্দরবান জেলায় প্রতিবছর যে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসা যাওয়া করতো, সেগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। পাহাড়ের অর্থনীতি হয়ে পড়েছে বিপন্ন। প্রকৃতপক্ষে এটাই হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বাঘ। সরকার সে বাঘকে আড়াল করে এখন সেন্ট মার্টিন-এর ননইস্যুকে ইস্যু বানানোর চেষ্টা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার ফলে সে এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ফলে, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র চাঁদাবাজ সংগঠনগুলোর পোয়াবারো অবস্থা। এখানে সব ধরনের ব্যর্থতা আড়াল করতেই সরকার এখন হাওয়াই সেন্ট মার্টিন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসছে। এগুলো শিগগিরি সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে।

https://dailysangram.info/post/529179