৬ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১:৫৭

সরজমিন মুগদা হাসপাতাল

যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশুরা

উম্মে হাবিবার চোখে পানি। ব্যথায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কষ্টে বুক ভারী হয়ে আছে বাবা সোলায়মানের। হাসপাতালের বেডে কোলে নিয়ে বসে আছেন হাবিবাকে নিয়ে। কান্না থামানোর জন্য আদর করছেন। কিন্তু ব্যথার কষ্ট সইতে না পারে কান্না আটকে রাখতে পারছে না। হাবিবা ডেঙ্গু আক্রান্ত। বয়স মাত্র সাড়ে ৫ বছর। বসবাস করেন রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এখন চিকিৎসা নিচ্ছে সে। তবে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরিবার। রক্তের প্লাটিলেট ধীরে ধীরে কমছে।
সোলায়মান জানান, হাবিবার জ্বর ছেড়ে ছেড়ে আসে। শরীরে ব্যথা আছে। ব্যথার কারণে কান্না করছে। ডাক্তার-নার্স দেখলেও ভয়ে কান্না করে। ডাক্তাররা স্যালাইনের মাধ্যমে এন্টিবায়োটিক ওষুধ দিচ্ছে। ডেঙ্গু মশা রোধে এলাকায় ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটানো হয় না বলে আক্ষেপ করেন সোলায়মান। তিনি বলেন, মশার ওষুধ শুধু মেইন রোডে দেয়। কোনো গলিতে কিংবা বাসার মধ্যে দিয়ে যায় না। হালকা বৃষ্টিতেই এলাকায় পানি জমে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়। এসবেই মশা জন্মায়।

আব্দুল্লাহ জুনায়েদের বয়স সাড়ে ৪ বছর। হাসপাতালের বেডে বসে মায়ের কোলে কাতরাচ্ছে। গত শুক্রবার রাতে তার জ্বর হয়। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে জ্বরের ওষুধ খাওয়ানো হলেও দু’দিনে জ্বর কমেনি। বরং শারীরিক পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে থাকে। পরে স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এখন মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে জুনায়েদ। তার মা রিনা বেগম বলেন, তার শরীর ব্যথা। ছেড়ে ছেড়ে জ্বর আসে। তবে অন্য কোনো উপসর্গ নাই। জ্বরের কারণে খেতে চায় না। শুধু কান্না করে।
গতকাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে ৩৩১ জন। এর মধ্যে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ১১৩ জন। হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর সংখ্যা ২৬১ জন ও ৭০ জন শিশু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় একজনের মৃত্যুও হয়েছে। আর চলতি জুলাই মাসের মাত্র ৫ দিনে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন রোগী ভর্তি ৪৭৭ জন।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, অন্য সময়ের চেয়ে হাসপাতালটিতে দ্বিগুণের বেশি রোগী আসছেন। রোগীর বাড়তি চাপে হাসপাতালজুড়েই উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। সিঁড়িতে গাদাগাদি ও লিফটেও রোগী ও স্বজনদের লম্বা লাইন। ডেঙ্গু চিকিৎসায় সুনাম রয়েছে মুগদা হাসপাতালের। তাই অন্য হাসপাতালের তুলনায় এখানে ডেঙ্গু রোগীদের ভিড় বেশি দেখা যায়। হাসপাতালটিতে পুরুষ, নারী ও শিশুদের আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১০ তলায় মেডিসিন বিভাগের পুরো জায়গাজুড়ে শুধুমাত্র পুরুষ ডেঙ্গু রোগী ও তৃতীয় তলায় শুধুমাত্র নারী ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ৮ তলায় শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত বেডের চেয়ে দ্বিগুণ ভর্তি হওয়ায় এসব ওয়ার্ডে কানায় কানায় রোগী দিয়ে পরিপূর্ণ। মেঝেতেও শয্যার ব্যবস্থা করে চিকিৎসা দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছেন হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরও অধিকাংশ রোগীকেই মশারি ছাড়াই থাকতে দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগীদের মশারির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গরমের কারণে তারা মশারি টানাতে অনীহা প্রকাশ করে।

মুগদা হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীরা ভিন্ন উপসর্গ ও জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এরমধ্যে একাধিকবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের শারীরিক অবস্থা কিছুটা গুরুতর বলেও জানান তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন ডেঙ্গুর ধরন পাল্টাচ্ছে। একদিন জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি অর্থাৎ ভাইরাস জ্বরের লক্ষণ দেখা যায়। অন্য কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কিন্তু হঠাৎ করে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গু সাধারণ লক্ষণ জ্বর। ১০৪-১০৫ ডিগ্রি উচ্চ তাপমাত্রা। শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা। এগুলোকে বলে হাড়ভাঙা জ্বর। ৪-৫ দিন পর এই জ্বর কমে যায়। তখন প্লাটিলেট কমে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু এখন ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। এসব লক্ষণ দেখা যায় না। এখন ভাইরাস জ্বরের লক্ষণ দেখা যায়। পরে হঠাৎ রোগীর অবস্থা জটিল হয়। রোগীর পালস, ব্লাড প্রেসার পাওয়া যায় না, প্রস্রাব হয় না। অজ্ঞান হয়ে যায়। এটাকে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এটা ডেঞ্জারাস। যারা মারা যাচ্ছে এই ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে শিশুদের ঝুঁকিটাও বেশি। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অল্পতেই কাবু হয়ে যায়।

জ্বর, মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি হলেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে ডেঙ্গু টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু দ্রুত ধরা পড়লে এর জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই কেউ যেন অবহেলা না করে। যারা গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে তারা আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে সিরিয়াস হয় না। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থবার হলে ডেঞ্জারাস হয়ে যায়। এখন তাই হচ্ছে। অনেকে ঢিলেমি করে হাসপাতালে আসার কারণে সমস্যা বেশি হচ্ছে।

ঈদুল আজহার দিন সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাসেল। তখন ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর আসে তার। পরে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তরে তিন দিন সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে ডাক্তারদের পরামর্শে মুগদা হাসপাতালে এসে ভর্তি হন তিনি। রাসেল বলেন, ঢাকা থেকে গত বুধবার গ্রামে (লক্ষ্মীপুর) যাই। পরেরদিনই জ্বর হয়। গ্রামের ডাক্তার এখানে চিকিৎসা নিতে বলেছে। এখন একটু উন্নতির দিকে। রাসেল জানান, রাজধানীর দনিয়া এলাকায় থাকেন। সেখানে ডোবা, ড্রেন ও ময়লা-আবর্জনার কারণে মশার প্রকোশ বেশি।

বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব খারাপ উল্লেখ করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা মো. নিয়াতুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, রোগীর ভর্তি ক্রমাগত বেড়ে গেছে। গত জুনে আমাদের এক হাজার ৮০০-এর বেশি রোগী ছিল। কিন্তু সেটা চলতি মাসের ৪ দিনেই ৫০০-এর বেশি হয়ে গেছে। সুতরাং এটা যে ঊর্ধ্বমুখী সেটা বুঝা যাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে তিনটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তৃতীয় তলায় নারী ওয়ার্ডে ১২০ জন ও দশ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে ১৪০ জন রোগী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর শিশু ওয়ার্ডে ১২০ জনকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ১১ তলাও প্রস্তুত করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সেখানেও রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে।

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, আমাদের ওয়ার্ড বাড়ছে। তাই চিকিৎসক সংকটও তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের এখানে ৯ জন চিকিৎসক পদায়ন করা হয়েছে। রেশনিং করে ডাক্তার ও নার্সদের দ্বারা চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আগে যাত্রাবাড়ী, কাজলা, ধলপুর ও এর আশেপাশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বেশি রোগী আসতো। কিন্তু এখন সব এলাকা থেকেই রোগী আসছে। ঢাকার বাইরে থেকেও ৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। আমরা সবভাবে প্রস্তুত রয়েছি।

https://mzamin.com/news.php?news=63267