৬ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১:৪৬

পরিবেশ বিপর্যয় ও উষ্ণতা বৃদ্ধি

চিংড়ি শিল্প ধ্বংসের মুখে

উৎপাদন খরচ চার গুণ দাম বেড়েছে দুই গুণ

বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি বিদেশে মৎস্য খাদ্যপ্রিয় ভোজন রসিক ক্রেতাদের জন্য প্রিয় নাম। বিদেশের বাজারে এই মৎস্যখাদ্য বাংলাদেশের পরিচয় বহন করছে কয়েক দশক ধরে। বিদেশের বাজারে ক্রমান্বয়ে এই খাদ্য জনপ্রিয় হয়ে উঠার পাশাপাশি চিংড়ি রফতানি করে আয় করছে উল্লেখযোগ্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাও। কিন্তু জাতীয় অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃতিগত উন্মাসিকতায় এখন এই চিংড়ি সেক্টর ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ইয়ারবুক অব ফিশারিজ স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী,২০০৩-০৪ অর্থবছরে দেশে চিংড়ির উৎপাদন ছিল ৭৫ হাজার ১৬৭ মেট্রিক টন। ওই বছরে বিদেশে রফতানি হয় ৩৭ হাজার ৭৪৮ টন। আয় হয় ৩৯০ মিলিয়ন ডলার। এটা বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০১২-১৩ সালে উৎপাদন বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার ২৬১ টন। রফতানি হয় ৫০ হাজার ৩৩৩ টন। বৈদেশিক মুদ্র আয় হয় ৫৪৪ মিলিয়ন ডলার। এর পর থেকে উৎপাদন ও রফতানি কমতে শুরু করে। ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ টন। রফতানি হয়েছে ৩৬ হাজার ১৬৭ টন এবং আয় ৫০৮ মিলিয়ন ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে দাম বাড়ায় মৎস্য রফতানি আয় আগের বছরের ৪৭৭ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫৩২ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। তবে উৎপাদন হ্রাসের ধারা অব্যাহত রয়েছে। উৎপাদিত চিংড়ির রফতানি বাদ দিয়ে অবশিষ্ট দেশের চাহিদা জোগান দিচ্ছে।

চাষিদের অক্লান্ত চেষ্টায় চিংড়ি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস এবং দেশে মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন পরিবেশ বিপর্যয় ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন হ্রাস এবং চাষের খরচ বৃদ্ধির তুলনায় দাম কম হওয়ায় চিংড়ি চাষ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া প্রান্তিক চাষিরা অবহেলারও শিকার। সে সব কারণে অনেকে চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে কমছে চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন। রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ৬০-এর দশকে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। পরে এটি শিল্প হয়ে ওঠে। ৮০-র দশক থেকে বাগদা চিংড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি শুরু হয়। এখন আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। চাষের ব্যাপ্তিও হ্রাস পেয়েছে। দেশে ২০১৪-২০১৫ বছরে ২ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদার চাষ হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা চাষের জমির পরিমাণ হয় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৮ হেক্টর। চার বছরে কমে ৩১ হাজার ১৬০ হেক্টর। এ বিষয়ে সর্বশেষ পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে প্রতি বছরই চাষের জমি কমে যাচ্ছে বলে চাষিরা জানান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চিংড়ি চাষের শুরুতে ঘেরের মুখ খুলে দিলে নদী বা খাল থেকে লবণাক্ত পানির সাথে চিংড়ির পোনা ঢুকে যেত। প্রাকৃতিক খাবার খেয়েই সেগুলো বড় হতো। পরে চাষের বিস্তৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তনে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা কিনতে হচ্ছে। কৃত্রিম ফিড দিতে হচ্ছে। এখন আবহাওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তনে নদ-নদীর নাব্যতা কমছে। জোয়ারের স্বাভাবিক গতি নেই। পানিতে লবণের মাত্রা ও উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে চিংড়ির মৃত্যু হার বেড়েছে। বেড়েছে রোগবালাই। প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের নিয়মে চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির উষ্ণতা তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে চিংড়ি মেরে ফেলছে। এ ছাড়া জমির হারি, ফিড, পোনার দাম ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, অক্সিজেনের ব্যবহার এবং শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। অথচ চিংড়ির দাম সে হারে বাড়েনি।

চিংড়ি চাষিদের সমস্যার প্রকৃতি বোঝার জন্য চাষিদের সাথে কথা বলা হয়। পাইকগাছার লস্কর এলাকায় নিজেদের ১০০ বিঘা জমিতে ঘের করে বাগদা চাষ শুরু করেন মনিরুল ইসলাম কাগজী। তিনি জানান, এক সময় গোণের সময় দৈনিক কয়েক হাজার টাকা লাভ হয়েছে। কিন্তু এখন শুধু লোকসান। তিনি বলেন, যখন শুরু করেছিলাম তখন ঘেরের গভীরতা ছিল সাড়ে ৪ থেকে ৬ ফুট। ঘেরের ব্যবস্থাপনায় নৌকা ব্যবহার করতে হতো। এখন গভীরতা হয়েছে আড়াই থেকে ৩ ফুট, নৌকা লাগে না। অবশ্য কোথাও আর নৌকা নেই। ২০০১ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হতো সর্বোচ্চ ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখন হচ্ছে ৪০ ডিগ্রি। তার পর লবণ পানিতে তাপ আরো ৭ ডিগ্রি বেশি অনুভূত হয়। এ তাপে চিংড়ি বাঁচানো অসম্ভব। এরপর ২০ বছর আগে ঘেরে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে মেশিন চালাতে হতো পুরো সিজনে ১০ থেকে ১৫ দিন। তাও রাত ১২টার দিকে চালিয়ে ফজরের নামাজের সময় বন্ধ করলেই চলত। এখন মেশিন ২৪ ঘণ্টা চালিয়েও মাছ রক্ষা করা যায় না। পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বেড়েছে। আগে ছিল ৮ থেকে ৯ পিপিটি, এখন হয়েছে ১৮ থেকে ২০ পিপিটি। কুয়াশা চিংড়ির জন্য উপকারী। কয়েক বছর আগে আমরা ফাল্গুন মাসে কুয়াশার দেখা পেতাম, এখন চৈত্র মাসের মাঝামাঝি গিয়ে কুয়াশার দেখা মেলে। তখন শ্রমিক পিছু মাসিক ব্যয় ছিল ৩ হাজার টাকা। বর্তমানে ১২ হাজার টাকার কমে শ্রমিক মেলে না। এরপর আমাদের চাষে টিকে থাকার কোনো সরকারি সাহায্য নেই।

রফতানির ইনসেনটিভ পায় প্রসেসিং কোম্পানির মালিকরা। আর চিংড়ি চাষি সমিতির সদস্যদের নামে জিও-এনজিও থেকে যা দেয়া হয় তা যায় সমিতির কথিত নেতাদের পেটে। এর পর এ সেক্টরে মধ্যস্বত্বভোগীরও সৃষ্টি হয়েছে। থাইল্যান্ডের সিপি অ্যাকুয়াকালচার ফিড কোম্পানির এক ডিলার আছেন পুরো সিজনে চাষিদের ফিড এবং ওষুধ বাকিতে দিয়ে যান। বাকি হলে দাম একটু বেশিই হয়। মাছ ধরার সময় ডিলার ঘেরে গিয়ে টাকা আদায়ের নামে সব মাছ নিয়ে যান। তখন চাষির বুড়ো আঙ্গুল চোষা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। তার এ পলিসিতে সেমি ইনটেনসিভ চিংড়ি চাষের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন বেনামি চাষেও যদি ওই ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশ করে তাহলে কোনো চাষি বেনামি করবে বলে মনে হয় না। মনিরুল কাগজী জানান, চিংড়ি উৎপাদন খরচ বেড়ে চার গুণ হয়েছে। পক্ষান্তরে চিংড়ির দাম হয়েছে দুই গুণ। সরকারি কারিগরি সহায়তাও নেই। পোনা টেস্টের পিসিআর দরকার কয়েক শ’। আছে মাত্র কয়েকটি। তাই আমি বাধ্য হয়ে এ বছর পুরো ঘের এলাকায় পুকুর খনন শুরু করেছি। চিংড়ি আর না। সাদা মাছ করব।
খুলনা বিভাগীয় পোনা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পাইকগাছা উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত ঘের ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া রিপনের কণ্ঠেও প্রায় একই সুর। তিনি বলেন, জানুয়ারি মাস থেকে নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি চলে আসতো। গত বছর এক মাস পিছিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে লবণাক্ত পানি আসে। এ বছর তাই হয়েছে। আগে সনাতন পদ্ধতির ঘেরে হ্যাচারির পোনা ছাড়ার পর ৬০-৭০ শতাংশ টিকতো। এখন ১৫-২০ শতাংশ পোনাও বাঁচে না।

কয়রার কুশোডাঙ্গার চাষি এহতেশামুল হক শাওন উপরের কারণগুলোর সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করে বলেন, গত সিজনে খুলনার দেশবাংলা হ্যাচারির চিংড়ি পোনা নিয়ে আমার মতো খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার অনেক চাষি পথে বসে গেছে। আগে কক্সবাজার থেকে পোনা নিয়ে আসায় চাষিরা এভাবে মার খায়নি। দেশবাংলার পোনা ঘেরে ছাড়ার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে অধিকাংশ মারা যায়। যে অল্পসংখ্যক বেঁচে ছিল সেগুলোর গ্রোথ হয়নি। সেই সাথে যোগ হয়েছে নিম্নমানের ফিড। থাই সিপি ফিড আসে ইন্ডিয়া ঘুরে। ডিলার একজনই, মনোপলি ভোগ করেন। তাতে কোনো প্রোটিন থাকে না। গত সিজনে কয়েক দফায় বাড়ানো আকাশচুম্বী দামের এ ফিড বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করেও কোনো লাভ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক চাষিদের দেখার কেউ নেই। তারা কখনো কোনো প্রণোদনা দূরের কথা, ক্ষতিপূরণ বা অর্থ সহায়তা পায় না। পান শুধু এক্সপোর্টাররা।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্লানিং বিভাগের অধ্যাপক ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. মোস্তফা সারোয়ার বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চিংড়ি রেণুর মৃত্যুহার বেড়েছে। প্রাকৃতিক খাদ্যচক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃত্রিম খাবার দেয়া লাগছে। বেশি তাপমাত্রায় রেণুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি হয় না। আর ঘেরের গভীরতা কম হওয়ায় বায়ুর তাপে পানি গরম হয়ে চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাপমাত্রা বাড়লে সব ধরনের ভাইরাসের দাপটও বেড়ে যায়।

এ ব্যাপারে খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে চাষিদের ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি চাষি থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানির মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/760089