৬ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১:৪৫

চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৬২ জনের মৃত্যু

ডেঙ্গু রোগীতে ভরে গেছে হাসপাতাল বেড সংকটে ঠাঁই হচ্ছে ফ্লোরে

হাসপাতালে ভর্তি ১০ হাজার ৪৫৫ রোগী

দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। মারাত্মক রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। সঙ্গে মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত জুন মাসে এ বছরের রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৌসুমের আগেই অবস্থা বেগতিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার এভাবে বাড়তে থাকলে চলতি জুলাই মাসেই শনাক্তের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।

বিশেষ করে ঈদুল আযহার পর যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৬০ শতাংশই ঢাকার বাইরের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টি, ঈদের ছুটি আর স্থানীয় সরকারের মশানিধন কার্যক্রমের দুর্বলতায় প্রতিনিয়ত রোগী বাড়ছে। এডিস মশার প্রজননকেন্দ্র ধ্বংস করার পাশাপাশি জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে অতীতে সব রেকর্ড ভেঙে আরও একটি দুর্যোগের বছর দেখতে হতে পারে বাংলাদেশকে।

ডেঙ্গু মৌসুম আসার আগেই এবছরে ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৫৮৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯১১ জনে। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬২ জনে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১১০০ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। তবে বেসরকারির তুলনায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেই রোগীদের আগ্রহ বেশি। রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইতিমধ্যেই ডেঙ্গু রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ডেঙ্গু কর্নার। জ্বর বা ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে যারা আসছেন তাদের রাখা হচ্ছে এই কর্নারে। পুরুষ এবং নারীদের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও রয়েছে আলাদা বিছানা।
হবিগঞ্জ থেকে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে রাসেল। তার বাবা আবদুল হাকিম বলেন, দুই-তিনদিন আগে হঠাৎ ছেলের জ্বর আসে। পাশাপাশি শরীর ব্যথা। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরীক্ষায় ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়ে। এখন চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার জানিয়েছেন যে, ফুসফুসে পানি জমে গেছে। সেটি সারাতে কিছুদিন সময় লাগবে।

আরেক ডেঙ্গু রোগী জুবায়ের বলেন, ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। গত ৩০ তারিখে জ্বর অনুভব করতে থাকি। ব্লাড টেস্ট করাতেই ধরা পড়ে যে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। এরপর এখানে এসে ভর্তি হই। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মোমেনা খাতুন। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হই। পাশাপাশি শরীরে তীব্র ব্যথা হতে থাকে। পরে চিকিৎসা নিতে এখানে এসেছি। এখন কিছুটা ভালোর দিকে যাচ্ছে। এদিকে হাসপাতালে ভর্তি হতে কোনো ভোগান্তির শিকার হতে হয়নি বলে জানিয়েছেন বেশিরভাগ রোগী।

এক রোগী বলেন, এখানে এসে বেড পেতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। টিকিট কাটা ছাড়া বাড়তি কোনো খরচ নেই। তাছাড়া ওষুধ ফ্রিতেই পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেডের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ডেডিকেটেড টিম প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ সাব্বির আহমেদ।

এই হাসপাতালে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছেন প্রায় ৫ থেকে ৬ জন রোগী। সুস্থ হয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রোগী ফিরেও যাচ্ছেন। তবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কোনো রোগী মারা যায়নি। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার করা হয়েছে, যেন তারা সহজেই চিকিৎসা পেতে পারেন। শুধু ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করবে, আমরা এমন একটি টিম তৈরি করেছি। ওয়ার্ডে বেডের পরিমাণ বাড়াচ্ছি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আমাদের ২০টি বেড ছিল, সেগুলো বাড়িয়ে ৩০টি করেছি। প্রয়োজনে সামনে বেডের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। কোনো রোগীকে চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে না।

এদিকে মুগদা হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীতে উপচে পড়া ভিড়ের খবর জানিয়েছে আরও দুইদিন আগেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগীর তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবলের সীমাবদ্ধতা থাকায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলেন, বেশির ভাগ রোগী আসছেন জ্বরের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত শরীর ব্যথা নিয়ে। এর সঙ্গে মাথা ব্যথা যুক্ত হওয়ার এক-দুইদিন পর হাসপাতালে আসছেন তারা। তবে দেরিতে এলেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন বেশিরভাগ রোগী।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমার হাসপাতালে। এখন আমার হাসপাতালে রোগী ভর্তি আছেন ২৫১ জন। এরমধ্যে গত একদিনে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৮৪ জন।

তিনি বলেন, আমার নার্সের সংকটও তীব্র, ডাক্তারের সংকটও তীব্র। তারপরও আমরা ম্যানেজ করে চালিয়ে নিচ্ছি। এক্ষেত্রে রেশনিং করতে হচ্ছে। যেখানে আমাদের অন্য একটা ওয়ার্ডে তিনজন চিকিৎসকের ডিউটি করার কথা, সেখানে দুই জন দিয়েই ২৪ ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। এরপরও ভালো লাগার বিষয় হলো, আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের সেবায় রোগীরা সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে।
ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে অন্যান্য হাসপাতালেও। সরকারের পক্ষ থেকে জ্বর হলেই টেস্ট করার কথা বলা হলেও অনেক মানুষই বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫৮৪ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৮২ জন এবং ঢাকার বাইরে ২০২ জন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৫৮৪ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯১১ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ২৮৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬২৬ জন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৪৫৫ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮ হাজার ৪৮২ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাই মাসে শনাক্ত ২ হাজার ৪৭৭ জন এবং মারা গেছেন ১৫ জন।

https://dailysangram.info/post/529142