৬ জুলাই ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১:৪৩

নানা পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকা

প্রতিবছর ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়, কত-শত আলোচনা ও উদ্যোগের কথা শোনা যায়। প্রশ্ন হলো, আসলে কি পরিবেশ দূষণ কমছে, পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে? মূলত: পরিবেশের সব ধরনের দূষণ যেন জীবনযাপনের নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

ঢাকাবাসীর জীবনে দূষণকে সাধারণ সংস্কৃতির অংশ বললেও অত্যুক্তি হবে না! নীতিনির্ধারক থেকে সাধারণ নগরবাসী দূষণ নিয়ে যেন কারোরই কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ঢাকাকে ব্যবহার করে সবাই যেন নিজেদের আখের গোছাতে চায়, কিন্তু শহরটার বাসযোগ্যতার কথা কেউ ভাবে না! বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদী-খাল দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, পানিদূষণ, বর্জ্যদূষণ, পানিবদ্ধতাসহ বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকা শহর। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যার দখল-দূষণরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও দখল-দূষণ থেমে নেই। নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রকৃতি-প্রতিবেশ ব্যবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শহরের অভ্যন্তরের খালগুলোও দখলÑ দখলের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। একসময় ঢাকা শহরের মধ্যে ৫৪টিরও বেশি খাল ছিল। অধিকাংশ খাল দখল ও বর্জ্য-আবর্জনায় ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে। এখন কোনো রকমে ২৩টির মতো খালের অস্তিত্ব আছে। এগুলোও ব্যাপক দখল ও দূষণে জর্জরিত। খালগুলোর সাথে আশপাশের নদ-নদীর সংযোগ কাটা পড়ার কারণে বর্ষা মওসুমে পানিবদ্ধতায় নাকাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে। তাই আগামী দিনগুলোতে নদ-নদীর উপরিভাগের পানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। তাই ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলো দূষণ ও দখলমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শিল্পকারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও মানববর্জ্যরে দূষণে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের অন্যান্য নদ-নদীর পানি কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। নদী-খাল রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও সেভাবে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ‘নিষিদ্ধ’ করা হলেও এর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি বরং যেন বেড়েছে। অবশ্য পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য না করার কারণে পলিথিন দূষণ থামছে না বলে মনে করছেন অনেকেই। অপচনশীল এই পলিথিন ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার ক্ষতিসহ সার্বিক পরিবেশ ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বরছেন, পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক অভিযান চলমান না রাখলে এটির ব্যবহার দিনদিন বাড়বেই।

সূত্র মতে, বিশ্বের অন্যতম বায়ুদূষণের শহর মেগাসিটি ঢাকা। বিশ্ব ব্যাংকের সম্প্রতি এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আর দূষণের কারণে ২০১৫ সালেই শহরাঞ্চলে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। ২০১৫ সালেই রাজধানী ঢাকায় শুধু বায়ুদূষণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে শহরের শিশুদের একটা বড় অংশ বায়ুদূষণের শিকার। বায়ুদূষণে শিশুর বিকাশ ও মেধা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলত বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তু কণা পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫-এর পরিমাণ যত বেশি সে শহর তত বেশি দূষণে জর্জরিত (যদিও পিএম ২.৫ এর মাত্রা ২০ এর বেশি হওয়া উচিত নয়)। তথ্য মতে, ২০১৫ সালে রাজধানীতে ‘পিএম ২.৫’-এর গড় ছিল ৮১ মাইক্রোগ্রাম। যতই দিন যাচ্ছে ঢাকার বাতাসে ‘পিএম ২.৫’-এর দূষণ বাড়ছে। গৃহস্থালি বায়ুদূষণও বেড়ে যাচ্ছে। শব্দদূষণ ঠেকাতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ‘বিধিমালা-২০০৬’ যেন থেকেও নেই। বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে! দেখা যায়, রাস্তায় একচিলতে নড়ার জায়গা নেই, তবুও গাড়িগুলো হর্ন দিয়েই চলে!

মাটি ও পানি দূষণেও শহরবাসীকে ভুগতে হচ্ছে। পানিতেও ভেজাল। নিরাপদ পানি পাওয়া এ শহরবাসীর জন্য এক চ্যালেঞ্জ। নিরাপদ পানির কথা বলে জারে ও বোতলে দূষিত পানি ভরে দেওয়া হয়। উচ্চ দামেও মেলে না নিরাপদ পানি! বর্জ্য তথা ময়লা-আবর্জনার দূষণ এ শহরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আধুনিক ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলার ফলে ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ঢাকা শহরে সড়কের সাথেই গড়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনা রাখার স্থান বা ‘সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন’ (এসটিএস)। ফলে চলতে-ফিরতে বর্জ্য দূষণের শিকার হতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

দূষণ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ল্যানসেট কমিশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণ ও সিসার বিষক্রিয়ায় ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ এর বেশী মানুষ মারা যাচ্ছেন। অনলাইন জার্নাল ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথে প্রকাশিত এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে প্রতি ৬ জনে একজন দূষণের কারণে মারা গেছেন। যুদ্ধ, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, যক্ষ্মা বা মাদকের কারণে বার্ষিক বৈশ্বিক মৃত্যুর চেয়ে এ হার বেশি। গবেষণার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দূষণের কারণে মৃত্যুর হার গত ২ দশকে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে। গবেষণার প্রধান লেখক রিচার্ড ফুলার বলেছেন, স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব প্রচুর। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ওপর এই প্রভাব পড়ে। বিশাল স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এজেন্ডায় দূষণ প্রতিরোধ উপেক্ষিত।

অন্যদিকে স্থাপত্য শিল্পের উন্নতির কারণে নিত্যনতুন স্থাপনার জন্য জোগান দিতে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণসামগ্রীর। নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম উপাদান ইট ও সিমেন্ট। প্রতিটি শিল্প বিভিন্নভাবে দূষিত করছে মাটি, পানি, বায়ু, নদীসহ ভূগর্ভস্থ পানিও। বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায় যে মোট বায়ুদূষণের ৫০ শতাংশেরও বেশি, নদীদূষণের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং শব্দদূষণের প্রায় ৩০ শতাংশ শিল্প-কারখানা থেকে সৃষ্ট।

রাজধানীসহ সারাদেশে পরিবেশ দূষণ, নদী ভরাটসহ নানাবিধ ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে আদেশ ও রায়ের ঘোষণা এসেছে। তবুও থামছে না দূষণ। পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা আদেশ প্রতিপালন করায় ভারসাম্য রক্ষা বা দূষণ কিছুটা কমলেও অপতৎপরতায় ফের বিপর্যয় বা দূষণ ঘটতে থাকে। প্রশাসন এ বিষয়ে আরও উদ্যোগী হলে পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব বলে মনে করেন আইনজীবী ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষকরা। পরিবেশদূষণ রোধে আদালতের আদেশ, সরকারি উদ্যোগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজের অগ্রগতি নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বায়ু, পানি, মাটি যে কোনো একটি দূষিত হলেই পরিবেশদূষণ ঘটে। তিনি বলেন, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহর যখন বিশ্বে এক নম্বর বায়ুদূষণের শহরে পরিণত হলো তখন হাইকোর্টে আমরা আলাদাভাবে রিট পিটিশন করেছিলাম। যেখানে আদালত ৯ দফাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না। যে আদেশগুলো হয়, তার সামাণ্য কিছু বাস্তবায়ন হয়, বড় অংশই বাস্তবায়ন হয় না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমাতুল করীম বলেন, আমি পরিবেশ ও বায়ুদূষণকে দুইভাবে দেখি। নাগরিক হিসেবে আমার একটা চাওয়া আছে, প্রত্যাশা আছে যে পরিবেশটা কী রকম হওয়া উচিত? আবার, আমি যখন পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন আইনজীবী তখন আমি তাদের বিষয়গুলো অন্য পরিপ্রেক্ষিতে দেখি। তিনি বলেন, ধরেন দেশে পরিবেশ রক্ষা, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের কাজ আইন করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশেষ করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দায়িত্ব পালনের জন্য যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেটি কিন্তু দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, আইন আছে প্রয়োগ করতে হবে। সবার আগে লোকবল ও সরঞ্জাম বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। পরিবেশের আইন কিন্তু সুন্দরভাবেই আছে। আমরা তা মানছি না।

বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, পরিবেশ হলো সর্বজনীন বিষয়। পরিবেশ দূষণে স্বল্প বা বেশি সবার ভূমিকা থাকে। প্রত্যেক মানুষ তার জীবনচক্রে কত আবর্জনা, বর্জ্য তৈরি করছে, কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করছে। বসতি তৈরির জন্য গাছ কাটছে। প্রতিটা মানুষই পরিবেশদূষণ করছে তার জন্য মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার মানুষই এটা সংরক্ষণের জন্য কথা বলছে, কাজ করছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়ন এ প্রক্রিয়ায় যখন অসহনীয় কোনো কিছু হয়ে যায় তখনই কোনো সংগঠন, সংস্থা বা উচ্চ আদালতের নজরে আসে। আবার আদালতে না গিয়েও বিভিন্ন পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠনের পক্ষ থেকে কাজ করা হয়। তিনি বলেন, শুধু আইনের প্রয়োগ করে পরিবেশ সংরক্ষণ বা দূষণ রোধ সম্ভব হবে না। যতক্ষণ না জনসচেতনতা তৈরি হয়।

https://dailysangram.info/post/529124