বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি কমলেও আমাদের দেশে এখনও কমছে না। বরং প্রতিদিন বেড়েই চলেছে এর দাপট। বিষয়টি উদ্বেগজনক বটে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের জুন মাসে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৫ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ৮.৭ শতাংশ। আর এবছর জুন মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৯.৭৪ শতাংশ। এ হিসাব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর। গত মে মাসে ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। গত এক যুগের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ। এ যখন বাংলাদেশের অবস্থা, তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশে দেখা যায় নি¤œরূপ: একই সময়ে আমেরিকা ও বৃটেনে মূল্যস্ফীতি ৯.১ থেকে ৪ এবং ৯.৪ থেকে ৬.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা জুন ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ এর অবস্থা। আমেরিকা ও বৃটেন উন্নত দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের কী অবস্থা? একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া বলতে গেলে সব দেশেই মূল্যস্ফীতি কমেছে। পাকিস্তানে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ৩৭.৯ শতাংশ।
দেশটিতে বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এ কারণে দেশটি এখন আইএমএফের কাছে ঋণ চাচ্ছে। পাকিস্তানের কথা থাক। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মূল্যস্ফীতি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। এ বছর জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে। গত বছর একই সময়ে ছিল ৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে উন্নতি হচ্ছে। গত বছর শ্রীলঙ্কা নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি। রিজার্ভ সংকটে জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় দেশটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। সে শ্রীলঙ্কাও আজ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। গত বছর জুনে এ দ্বীপদেশটির মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ, সেখানে এখন তা ১২ শতাংশে নেমেছে। ভাবা যায়?
করোনা মহামারি শেষ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে আরও অস্থির করে তোলে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তো বটে, ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোও বেকায়দায় পড়ে। হু হু করে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে সবদেশই প্রমাদ গুনতে শুরু করে। কেননা এতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ে কয়লা, গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম। একই সঙ্গে বাড়ে ভোজ্যতেল, গমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দামও। এর সঙ্গে যোগ হয় অস্বাভাবিক জাহাজ ভাড়া বা পরিবহন ব্যয়। এ কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বাড়ে মূল্যস্ফীতি। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক রিজার্ভে টান পড়ে। কিন্তু গত ছয় মাসে এ দুঃসহ পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। ফলে অধিকাংশ দেশের মূল্যস্ফীতির আগের চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে কমতে এখন তা ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলার। ভোজ্যতেল, খাদ্যশস্য, সার, কৃষিখাতের কাঁচামাল, ব্যবহারিক বা শিল্পপণ্যের মূল্যও কমছে গত কয়েক মাস ধরে। কিন্তু আমাদের দেশে এর কোনও প্রভাব নেই। এখানে একবার কোনও পণ্যের দাম বাড়লে নিয়মানুযায়ী তা কমে না।
এমন পরিস্থিতে দেশের পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অগভীর, সামান্যতে কেঁপে ওঠে’। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে এখনও আগের অর্ডার আসছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমবে কিভাবে? এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকায় এতে কোনও কাজ হচ্ছে না। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকানো হয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ ও আমদানির মধ্যে নেই সুসমন্বয়। ডলারসংকটে ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। এটা কত বড় এক সংকট তা ব্যবসায়ী ছাড়া আর কারুর পক্ষে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা অসম্ভব। এসব প্রতিকূলতা কেটে উঠতে পারলে মনে হয়, এদেশেও মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা যেতে পারে। তবে এজন্য ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা আবশ্যক। কিন্তু তাদের তেমন সুযোগ নেই। তারা এখন আখের গোছানোতেই ব্যস্ত।