৫ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১:২৭

ঢাকায় বেপরোয়া ছিনতাই দেড় বছরে ৩০ খুন

রাজধানী ঢাকায় গত দেড় বছরে চার শতাধিক ব্যক্তি ছিনতাইকারীর হামলার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৩০ জন ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এবং বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রতিকার মেলে কম।

হয়রানির ভয়ে বেশির ভাগ ভুক্তভোগী থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি করেন না। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিনতাইকারীদের ঠেকাতে তাঁদের বিশেষ তৎপরতার কথা বলেছেন। কিন্তু এর পরও ছিনতাই কমছে না।

ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে তেজগাঁও, উত্তরা, মিরপুুর, ধানমণ্ডি, ওয়ারী ও মতিঝিল এলাকায়।
পুলিশের অপরাধবিষয়ক মাসওয়ারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে গত দেড় বছরে ৪৮২টি ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত বছর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫৫টি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব স্থানে পুলিশের টহল নেই বা জায়গা নির্জন, সেসব স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ থানা এলাকায় রাত ১০টার পর পুলিশ থাকে না। টহল পুলিশের গাড়িও কম দেখা যায়।

পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা বলছেন, মূলত ভাসমান মানুষ ও মাদকসেবীরা ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশি জড়াচ্ছে।
ছিনতাইয়ের ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্তত ১৭ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার সময় আশপাশে চিৎকার করেও তাঁরা পুলিশের সহযোগিতা পাননি। এতে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন।
পুলিশের ঊর্ধ্বতনরাও এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন।

বর্তমানে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় মাঠ পর্যায়ের পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। র‌্যাবের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে এক হাজার ১৫০টি অভিযানে দুই হাজার ৪৩৮ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হতাহতের কয়েকটি ঘটনা : সর্বশেষ গত শনিবার ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টের সামনে ছুরিকাঘাতে মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার (৪০) নামের এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। মনিরুজ্জামান ডিএমপির তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। পুলিশ তদন্ত করে বলছে, ছিনতাইকারীর হাতেই তিনি খুন হয়েছেন।

এর আগে গত বছরের অক্টোবরে ভোরের দিকে হাঁটতে বের হয়ে ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শাহাদত হোসেন ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন। পুলিশ তদন্ত করে বলছে, ছিনতাইকারীর হাতে তিনি খুন হয়েছেন।

গত ৫ অক্টোবর কারওয়ান বাজার প্রিন্স হোটেলের সামনে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন কেশব চন্দ্র রায় (পাপন)। তিনি সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত বছর ১১ আগস্ট রাতে উত্তরায় একটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার সময় বুথের ভেতরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন ব্যবসায়ী শরিফ উল্লা। একই বছর ২৯ জুলাই পল্লবীতে আরমান নামের এক রিকশাচালককে গলা কেটে হত্যার পর তাঁর রিকশাটি নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। এর আগে ৬ জুলাই কামরাঙ্গীর চরে ছিনতাইকারীরা সাঈদ নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এর আগে ২৭ মার্চ ভোরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল প্রাণ হারান।

গত ৩০ জুন দিবাগত রাত আনুমানিক ২টায় হাতিরঝিল এলাকায় ইনডিপেনডেন্ট টিভির দুজন সাংবাদিক ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তাঁদের মধ্যে সাংবাদিক রাকিবুল হাসান রানা ছিনতাইকারীর হাতে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ২৪ জুন মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার ৩ নম্বর সড়কে মো. সেন্টু ওরফে শাকিল নামের এক যুবক ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েন। তারা তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।

উত্তরার সানজিদা রাফসানজানি নামের এক নারী ভুক্তভোগী বলেন, ছিনতাইকারী ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার সময় তাঁর হাত আটকে যায়। তখন সেই ছিনতাইকারীদের প্রাইভেট কারটি তাঁকে টেনেহিঁচড়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়।

পুলিশের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধেও ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে রাজধানীর মতিঝিলে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তিন পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। তাঁরা হলেন মো. কামরুল ইসলাম (৩৫), রাফিজ খান (২৬) ও তুষার ইমরান (৩১)।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়ছে ছিন্নমূল মানুষ। ছিন্নমূল কিশোর-তরুণ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাতে তারা প্রাথমিকভাবে জড়াচ্ছে ছিনতাইয়ে। দিনের বেলায় মোবাইল ফোনসেট, ব্যাগসহ জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ছে। রাতে তারা পথচারীদের ছুরি মেরে টাকা-মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে বেকারত্ব, মাদক ও কিশোর অপরাধের মতো অনেক বিষয় জড়িত। ছিনতাই কমাতে রাতে টহল দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে আরো সতর্ক হতে হবে।

ছিনতাই, দস্যুতা ও ডাকাতির বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে গত রবিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঈদের ছুটিতে রাজধানী ফাঁকা থাকায় পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ড ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তবে নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো দুর্বলতা ছিল কি না, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখতে ডিএমপি কমিশনারকে বলা হয়েছে। তিনি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

ছিনতাই নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, রাজধানীকে ছিনতাইকারীমুক্ত না করা পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ অভিযান চলবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/05/1295635