৫ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১:১৯

ডলার সংকট কাটছেই না

দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে লাগাম টানতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এ ছাড়াও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। তবুও ডলার সংকট কাটছে না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এ আয় বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে গত জুন মাসে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে রেমিট্যান্সে। এই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা প্রায় তিন বছরের মধ্যে একক মাস হিসেবে দেশে আসা সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়।

এরপরও দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটছে না।
সর্বশেষ গত সোমবার থেকে বাজারভিত্তিক দরে ডলার বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দামও সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন ঘটেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, কিন্তু আমদানি ব্যয় মেটাতে খরচ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। ফলে ডলার সংকট কাটানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দেনা পরিশোধের ঝুঁকি এড়াতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গত অর্থবছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছর বিক্রি করে আরও ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে বিক্রির ফলে ক্রমেই রিজার্ভ কমে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে এবার একাধিক বিনিময় হারভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে, বাজারভিত্তিক একক বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে গত জানুয়ারিতে আইএমএফের অনুমোদিত ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণেরও অন্যতম শর্ত ছিল একক বিনিময় হার চালু। সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পদক্ষেপ নিলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা অনুসারে বিনিময় দর ঠিক করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা)। গত সোমবার সংগঠনটি জানায়, এখন থেকে ডিলার ব্যাংকগুলো যে রেটে ডলার কিনবে তার সঙ্গে এক টাকা যোগ করে বিসি সেলিং (বিলস ফর কালেকশন) রেট দেবে। তবে এই রেট ১০৯ টাকার বেশি হতে পারবে না। ব্যাংকগুলো এখন রপ্তানি বিল ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা, রেমিট্যান্স ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে কেনে। ডলার কেনার গড় দরের সঙ্গে সর্বোচ্চ এক টাকা যোগ করে আমদানির দর ঠিক করে। তবে আন্তঃব্যাংকে ডলারের সর্বোচ্চ দাম হবে ১০৯ টাকা।

ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অর্থবছরের রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তার আগের অর্থবছরে বিক্রি করে আরও ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির কারণে ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আন্তঃব্যাংক হারে ডলার বিক্রির মাধ্যমে আইএমএফের শর্তপূরণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের একক হারের ধারণার সঙ্গে এটি সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায়, তাদের শর্তপূরণ হয়েছে। তবে এখনো বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করা বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বর্তমানে কার্যকর কোনো বাজার নয়। বর্তমানে এই বাজারে দৈনিক ১-২ মিলিয়ন লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু, যখন একাধিক বিনিময় হার ছিল না, তখন বাজারটি ছিল আরও সক্রিয়। আমি একদিনেই ৬০০ মিলিয়ন লেনদেন হতে দেখেছি। তাই আন্তঃব্যাংক হারকে বাজারভিত্তিক দর বলা যাবে না। তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ডলার কেনার দরে সীমা থাকায়, আন্তঃব্যাংক হারের বাজারভিত্তিক চালিকাশক্তির অভাব রয়েছে। যেমন ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার কিনছে, তার ওপর সর্বোচ্চ ১ টাকা মুনাফা করতে পারে, এতে ডলার কেনার ওপর একটা সীমা আরোপ হয়ে যাচ্ছে, যা আন্তঃব্যাংক হারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর একটি ছোট উদ্যোগ বলে মনে করছেন তিনি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানিতে কড়াকড়ি করার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট সমাধান করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। এ ছাড়া এলসি খুলতে বিদেশি ব্যাংকগুলো মুখ ফিরিয়ে নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এজন্য ডলার সংকট দ্রুত সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, ডলার সংকটের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে অর্থ পাচার। বিগত সময়ের তুলনায় নির্বাচনী বছরে অর্থ পাচার আরও বাড়তে পারে। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগে যে পরিমাণ ডলার প্রতি বছর আসতো, এখন তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের রপ্তানি ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ১ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে ১৯৪১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমে ৪৫০ কোটি ডলারে নেমে আসে।

২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে ঘাটতি ছিল ১৭২৭ কোটি ডলার। তবে বিভিন্ন সময়ে নেয়া বিদেশি ঋণ যে হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে, নতুনভাবে আসছে তার চেয়ে কম। এতে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে আর্থিক হিসাব সব সময় ইতিবাচক থাকে। তবে বিদায়ী অর্থবছরে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫৮ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ১ হাজার ৩৩৭ কোটি ডলার। আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতি পরিস্থিতি সামগ্রিক বৈদেশিক মুদ্রা খাতকে চাপে রেখেছে। বিদায়ী অর্থবছরের মে পর্যন্ত সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি হয়েছে ৮৮০ কোটি ডলার। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৫৫৯ কোটি ডলার।

https://mzamin.com/news.php?news=63094