৫ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১:০২

মীণ রাস্তায় সেতু, কালভার্ট প্রকল্প

দেবে গেছে প্রকল্পের অ্যাপ্রোচ রোড, সেতুর রেলিংয়ে ভাঙন

মেয়াদ বাড়িয়েও প্রকল্পের গতি নেই। প্রকল্প চলমান, নির্মিত অ্যাপ্রোচ রোড এখনই দেবে গেছে। গ্রামীণ সড়কের সেতুগুলোয় নির্মিত রেলিংয়ে ভাঙন ধরেছে এখনই। গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পে এই সব চিত্র। মাত্র দু’টি নির্দিষ্ট আকৃতির নকশা দিয়ে সেতুর কাজ বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সাড়ে তিন বছরের প্রকল্প সোয়া চার বছরে কাজ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৪৯ শতাংশ। তবে বর্ধিত মেয়াদে প্রকল্পের সময় আছে আর ১৪ মাস মাত্র। ওই সময়ের মধ্যে ৫০.৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে, পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে মান নিয়ন্ত্রণ যথোপযুক্ত ছিল না। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রগতি কম হওয়ার মূল কারণ যথাসময়ে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া, কোভিড-১৯, স্থান নির্বাচনে বিলম্ব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষ করে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৭০ শতাংশ বন্যাপ্রবণ এলাকা। দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি, পুনরুদ্ধার, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম শর্ত হচ্ছে গ্রামীণ রাস্তার গ্যাপে সেতু বা কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করা। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় যেসব রাস্তা নির্মিত হয়েছে, সেসব রাস্তা নির্মাণের সময় পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ না করার ফলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টিসহ প্রতি বছর বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে কৃষি ফসলের ক্ষতিসাধন করে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ৬ হাজার ৫৭৮ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ‘গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ’ প্রকল্পটি গ্রহণ একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত বাস্তবায়নে এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়।

জানা গেছে, বাস্তবায়নে অগ্রগতি না হওয়ায় ব্যয় কিছুটা কমিয়ে মেয়াদ দু’বছর বাড়ানো হয়। ৬ হাজার ৫৪৫ কোটি ২৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়। এতে প্রকল্পের মূল পর্যায়ের তুলনায় সময় বৃদ্ধি ৫৭ শতাংশ এবং ব্যয় হ্রাস পায় দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সোয়া চার বছরে এক হাজার ৯৯০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা ৩০.৪২ শতাংশ খরচের বিপরীতে বাস্তব অগ্রগতি ৪৯.৫ শতাংশ। সময় অতিক্রান্ত বিবেচনায় প্রকল্পটির অগ্রগতি অনেকাংশে পিছিয়ে আছে বলে আইএমইডির পরামর্শক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

আইএমইডির নিযুক্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড বলছে, প্রকল্পটি বাংলাদেশের আটটি বিভাগের ৬৪টি জেলার সব উপজেলায় বিস্তৃত থাকায় মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন পরিদর্শনের ক্ষেত্রে দ্বৈব-চয়ন পদ্ধতিতে ৩২টি জেলার ৯৮টি উপজেলা নির্বাচন করে ১৯৬০ জন সুবিধাভোগীর সাথে কথা বলা হয়।

সরেজমিন পরিদর্শনের ক্ষেত্রে এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের তথ্য বলছে, এই সমীক্ষার অধীন ৯৮টি উপজেলায় মোট ১৯৬টি সেতু পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজের মান ভালো পাওয়া গেছে। তবে, ২৩টি সেতুর ক্ষেত্রে ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোড দেবে যাওয়া, ৭টি সেতুর উচ্চতা খুব বেশি, ১২টি সেতুর ক্ষেত্রে খালকে কিছুটা সঙ্কুচিত করা, অন্তত ১০টি ক্ষেত্রে কাজের মানে সমস্যা, ২টি সেতুর ক্ষেত্রে স্থান নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও দুটি সেতুর ইতোমধ্যে রেলিংয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেতুর ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতাও রয়েছে।

সেতুগুলোর নকশা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, মাত্র দু’টি নির্দিষ্ট আকৃতির নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা একেক অঞ্চলের একেকটি খালের আকার ও গভীরতা ভিন্ন ভিন্ন। ফলে অবকাঠামোগুলোর ব্যবহার উপযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে হ্রাস পেতে পারে। একইভাবে, উয়িং ওয়ালের সাইজ বাস্তবতার তুলনায় অনেক ছোট। এক্ষেত্রে উঁচু সেতুগুলোর অ্যাপ্রোচ রোডের সংযোগস্থলে দেবে গিয়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। যা ইতোমধ্যে সমীক্ষাভুক্ত এলাকায় ২৩টি সেতুতে দৃশ্যমান। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে রাস্তার ওপর চাপ তথা এর প্রস্থ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে সেতুগুলো শুরু থেকেই আরো প্রশস্ত করে নির্মাণ করা উচিত ছিল। অনেক ক্ষেত্রে, পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে মান নিয়ন্ত্রণ যথোপযুক্ত ছিল না বলে প্রতীয়মান।

সরেজমিনের তথ্য হলো, খাগড়াছড়ির বাটনাতলী ইউনিয়নের সেতুর অ্যাপ্রোচ রোডের সমস্যার কারণে বর্তমানে যানবাহন চলাচল সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত অ্যাপ্রোচ রোড সংস্কার প্রয়োজন। রসুলপুর ইউনিয়নের ব্রিজের কাজে অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠের সাটারিং করা হয়েছে। মান সন্তোষজনক নয়। রংপুর পীরগাছার নির্মাণাধীন ব্রিজের উইং ওয়াল ছোট এবং উচ্চতা বেশি। এতে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হবে। একই অবস্থা খুলনার দেলুটি ইউনিয়নে।

প্রকল্পের আরডিপিপি অনুযায়ী পণ্য, পূর্ত ও সেবা ক্রয় সংক্রান্ত মোট ২০টি প্যাকেজ রয়েছে। তার মধ্যে পণ্য ১২টি, পূর্ত ৬টি প্যাকেজে এবং সেবা প্যাকেজ দু’টি। এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত পণ্য ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে ১০টি এবং পূর্ত কাজের ৪ অর্থবছরে ৪টি প্যাকেজের অধীন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৭৫টি। এর মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে ৬ হাজার ৮৯১টি ও নির্মাণকাজ চলমান ৬৮৪টি সেতুর। সেবা প্যাকেজ দু’টির মধ্যে বাস্তবে দু’টি প্যাকেজেরই দরপত্র আহ্বান ও চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৪ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরে একটি অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। অডিটে উত্থাপিত আপত্তির সংখ্যা ১৪টি। আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য প্রকল্প অফিস কর্তৃক জবাব প্রদান করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আপত্তি নিষ্পন্ন হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশব্যাপী বিস্তৃত এই প্রকল্পটির তদারকির জন্য প্রকৌশল শাখার লোকবলের অভাব লক্ষণীয়। উপজেলা পর্যায়ে শুধুমাত্র একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ছাড়া আর কোনো কারিগরি লোকবল নেই। তৃণমূল পর্যায়ে, সারা দেশব্যপী পরিচালিত প্রকল্পটি ঢাকায় অবস্থিত মূল প্রকল্প অফিস থেকে তদারকি করা হচ্ছে। বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস ও আউটসোর্সিংসহ ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী নিয়োগের মাধ্যমে তদারকি আরো নিবিড় করা যেতে পারে। তাছাড়া প্রকল্প অফিসে ক্রয়কৃত অনেক মালামালের সঠিক হিসাব নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংরক্ষণ প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনের পরিপত্র ও ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্প পরিচালনার জন্য প্রতি তিন মাস অন্তর পিআইসি ও পিএসসি সভা আয়োজনের বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী জানুয়ারি ২০১৯ হতে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে মোট ৫২ মাসে ১৭টি পিআইসি ও পিএসসি সভা আয়োজন করার কথা। বাস্তবে ১৪টি পিআইসি ও ৮টি পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোভিড-১৯ এর বাস্তবতায় এ সংখ্যাটি সন্তোষজনক। তবে, প্রকল্পের ৫২ মাসে ৫ জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রকল্পের গতিকে ব্যাহত করেছে। তার মধ্যে ৪ জনই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম অর্থ প্রাপ্তিতে বিলম্ব ও ডিজাইনে সীমাবদ্ধতা, কাজের মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা, সম্ভাব্যতা যাচাই যথাযথভাবে না করা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রগতি কম হওয়ার মূল কারণ যথাসময়ে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া, কোভিড-১৯, স্থান নির্বাচনে বিলম্ব ইত্যাদি। প্রকল্পের অধীনে সারা দেশব্যাপী ১৫৬ কিলোমিটার বা ১৩ হাজারটি বক্স কালভার্ট বা গার্ডার নির্মাণ হওয়ার কথা। তার মধ্যে বক্স কালভার্ট ১২মিটার পর্যন্ত ৭ হাজার ৮শ’টি, অন্যটি গার্ডার সেতু ১২ মিটারের অধিক হতে ১৫ মিটার পর্যন্ত ৫ হাজার ২শ’টি। নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে, প্রতি অর্থবছরের জন্য একটি করে প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। আর ওই প্যাকেজের অধীনে একাধিক ব্রিজ বা বক্স কালভার্ট রয়েছে। প্রকল্প অফিস কর্তৃক অর্থবছরভিত্তিক বরাদ্দের বিপরীতে উপজেলাভিত্তিক চাহিদার আনুপাতিক হারে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে এককালীন ওই অর্থবছরের জন্য জিও জারি করা হয়। পরে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দরপত্র আহ্বান করে নির্মাণকার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস বলছে, প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ হলো সেতুর ডিজাইনে বাস্তব পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণকে বিবেচনায় আনা, সংযোগ সড়ক উন্নয়নে আরো গুরুত্ব দেয়া। এ ছাড়া উইং ওয়ালের ডিজাইন সংশোধন, স্থান নির্বাচনে আরো নৈর্ব্যক্তিক হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে পিআইও অফিসের লোকবলের অভাব দূরীকরণের লক্ষ্যে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু টেকনিক্যাল লোকবল নিয়োগ দেয়া।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/759834