৫ জুলাই ২০২৩, বুধবার, ১:০০

ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে ঢাকার সবাই বাইরেও ছড়াচ্ছে ব্যাপকভাবে

মঙ্গলবার মৃত্যু ৫ আক্রান্ত ৬৭৮ জন পরিস্থিতি ভয়াবহ

ঢাকার সবাই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গুর প্রাক মৌসুম জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৭টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর হটস্পট ঢাকা হলেও গ্রামে-গঞ্জেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রোগটি। ফলে গ্রামে-গঞ্জেও যথেচ্ছ পাওয়া যাচ্ছে কালো ডোরাকাটা দাগের এডিস মশা। গতকালও ঢাকার বাইরে রংপুরে একজনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এ নিয়ে গতকাল দেশে ডেঙ্গুতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকায় চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকলেও গ্রামে-গঞ্জে তা নেই। ফলে মানুষ চিকিৎসার জন্য চলে আসছে ঢাকায়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেলে ঢাকাগামী রোগীদের ঢল আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাইভেট চেম্বারে ভালো চিকিৎসকও পাওয়া যায় না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সন্ধ্যার পর চিকিৎসকের উপস্থিতি খুবই কম থাকে। এসব কারণে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও প্রিয়জনদের বাঁচাতে ঢাকায় চলে আসছেন মানুষ। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকায় ঢাকার আশে-পাশে অর্থাৎ ঢাকা বিভাগের জেলাগুলো থেকেই বেশি আসে রোগীরা।

এ দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ঢাকার প্রায় সবাই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা: মো: নাজমুল ইসলাম বলেন, জরিপকৃত ওয়ার্ডগুলোতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপস্থিতি অনেক বেশি। অর্থাৎ ঢাকায় আমরা সবাই ডেঙ্গু রোগের ঝুঁকিতে আছি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর সুনির্দিষ্ট করে ৫৭টি ওয়ার্ডকে চিহ্নিত করেছে যেগুলো ডেঙ্গুতে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ২৮টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ২৭টি ওয়ার্ড রয়েছে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ মিলে মোট ১১৯ািট ওয়ার্ড রয়েছে (উত্তরের ৫৪টি এবং দক্ষিণের ৭৫টি)। এই হিসেবে ঢাকার অর্ধেক ওয়ার্ডই ডেঙ্গুর ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ অবস্থান করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে এ জরিপ করা হয়েছে গত ১৮ থেকে ২৭ জুন। এর মধ্যে উত্তরের ৪০টি এবং দক্ষিণের ৫৮টি ওয়ার্ডে জরিপকারীরা পরিদর্শন করেছেন। এসব ওয়ার্ডের ৪ হাজার ১৪৯টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে উত্তরের ২৭২টি বাড়িতে এবং দক্ষিণে ২৭৮টি বাড়িতে লার্ভা মিলেছে। অধিদফতর বলছে, এসব ওয়ার্ডে এডিস মশার ব্রুটো ইনডেক্স ২০’র বেশি। ব্রুটো ইনডেক্স ২০’র বেশি হলেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জরিপকৃত ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড : ঢাকা উত্তর সিটির ২, ৩, ৫, ৬, ১০, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে। এই এলাকাগুলো হলো-মিরপুর, পল্লবী, মাজার রোড, পীরেরবাগ, মনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেত, কুড়িল, জোয়ার সাহারা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, কাওরানবাজার, তেজতুরী বাজার, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, বায়তুল আমান, মগবাজার, ইস্কাটন, বাড্ডা।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ। এই এলাকাগুলো হলো- গোরান, মেরাদিয়া, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদা, মাদারটেক, ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, রাজারবাগ, পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফেন্ট রোড, মিন্টো রোড, কাকরাইল, হাজারীবাগ, লালবাগ, আজিমপুর, পলাশী, বংশাল, সিদ্দিকবাজার,

শাঁখারীবাজার, রায় সাহেববাজার, ওয়ারী, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, সায়েদাবাদ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপাড়, গেণ্ডারিয়া, জুরাইন এবং কামরাঙ্গীরচর।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মুমূর্ষু না হলে ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে ডেঙ্গু রোগীরা কম আসে। সচেতনতার অভাবে কোনটা ডেঙ্গু জ্বর, কোনটা সাধারণ ভাইরাল জ্বর তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না বলে ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে র্যাশ (লাল হয়ে উঠা) না উঠা পর্যন্ত মানুষ হাসপাতাল অথবা ডাক্তারের কাছে আসছে না। এসব রোগীর মধ্যেই মৃত্যু বেশি।

গত সোমবার সকাল ৮টার পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টার আগে পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে ভোগে মারা গেছে ৫ জন এবং আক্রান্ত হয়েছে ৬৭৮ জন বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কনট্রোল রুম জানিয়েছে। চলতি বছর গতকালই ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্ত হলো। এর আগে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের গত ২ জুলাই ও ২৪ জুন এবং ২ জুলাই ৫০৯ জন আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪২৯ জন এবং ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৪৯ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সরবরাহ করা তথ্যে দেখা যায় চলতি জুলাই মাসের গত ৪ দিনেই (প্রকৃতপক্ষে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে রোগটিতে। তার তথ্য অনুযায়ী, এর আগে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে মারা গেছে ১৩ জন। গত জুনের ৩০ দিনে মারা গেছে ৩৪ জন। জুলাই ৪ দিনে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এক হাজার ৮৯৩ জন। জুনের ৩০ দিনের এক-তৃতীয়াংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে জুলাইয়ের ৪ দিনেই। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

গতকাল রাজধানীতে যে ৪২৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এর মধ্যে মুগদা জেনারেল হাসপাতালেই ২২০ জনকে ভর্তি করেছে। অবশ্য ঢাকার মধ্যে মুগদা হাসপাতালেই ডেঙ্গুর জন্য সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ৩৮ জন ভর্তি হয়েছে। মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৮ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১০ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৭ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন ভর্তি ছাড়া আরো কয়েকটি হাসপাতালে, বেসরকারি বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ ও ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে ১০ জন করে ২০ জন, ইসলামী ব্যাংক কাকরাইল হাসপাতালে ১৫ জন, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ১১ জন, আজগর আলী হাসপাতালে ১৮ জনসহ আরো কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ৫৩ জন ডেঙ্গুরোগীর ভর্তি হয়েছে।
রামেক হাসপাতালে ডেঙ্গুতে যুবকের মৃত্যু

রংপুর অফিস জানায়, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বুলেট (৩৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এখনো ৮ জন রোগী আক্রান্ত আছেন হাসপাতালে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: মোহাম্মদ ইউনুস আলী জানান, বুলেট জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ৩ জুলাই সোমবার ভর্তি হন রমেক হাসপাতালে। সেখানে মঙ্গলবার তার মৃত্যু হয়। মৃত বুলেট মহানগরীর পুরান সদর হাসপাতাল সুইপার কলোনির মানু লালের ছেলে।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা: মাহফুজার রহমান জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দু’টি ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেখানে সোমবার রাত পর্যন্ত ৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন রোগী মঙ্গলবার মারা গেছেন। আরেকজন সুস্থ হওয়ায় তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ৮ জন চিকিৎসাধীন আছেন।

রংপুর সিভিল সার্জন ডা: জাহাঙ্গীর কবির জানান, ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যাপারে ঈদের আগে থেকে রংপুর সিটি করপোরেশন, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়েছে। সবাইকে সাবধানতা অবলম্বনের আহ্বান জানান তিনি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/759837