২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:৩২

১০ হাজার কোটি টাকার অধিক ক্ষতি

# মরেছে ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও ৩০ হাজার হাঁস
# পানি নষ্ট হয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা

একে একে সবই গেল। ধান গেল, মাছ গেল। বেঁচে থাকার অবলম্বন বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্ধারিত সুনামগঞ্জের প্রধান ৪২টি হাওরসহ জেলার ছোটবড় সব ফসলী হাওরই জোয়ারের পানিতে তালিয়েছে। বোরোর ভাণ্ডারখ্যাত সুনামগঞ্জের ফসলী হাওরগুলো মানুষ্য সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখন অথৈ পানিতে নিমজ্জিত। বলা যায় ২৬ লাখ জনসংখ্যার সুনামগঞ্জ এখন শতভাগ ফসলহানির জেলা। ঢলের পানি আর প্রকৃতির সাথে কৃষকদের বেঁচে থাকার সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হয়েছে কৃষকদের। এতে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের সংগ্রামী মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হাওরের ফসলের সাথে শত সহস্র কৃষকের শ্রম ঘাম পরিশ্রমও ভেসে গেছে ঢলের পানিতে। এতে ধান, মাছ ও গো-খাদ্যের পচনে সুনামগঞ্জের ফসলহানীতে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সচেতন মহল। আর এর সবকিছুর জন্যই পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসিকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা। বাঁধ নির্মাণে সরকার কর্তৃক ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সময়মতো কাজ না করে বাঁধের টাকা লুটপাট করা ফসলহানীর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন সচতন মহল। তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বরাদ্দকৃত এই বিপুল অংকের টাকার কাজ নিশ্চিত করা গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হত।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করার কথা বলা হলেও এ জেলার ১১ উপজেলায় অন্তত আড়াই লাখ হেক্টর ফসলি জমির বোরো আবাদ পানিতে তলিয়েছে। যেখান থেকে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপন্ন হওয়ার কথা ছিল। টাকার অংকে যার পরিমান দাঁড়াবে ৪ হাজার কোটি টাকা। এত গেলো ফসলি জমি তলিয়ে ধানের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান। তার উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয় মাছের মড়ক। চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ে একে একে সুনামগঞ্জের সবকটি হাওরের ফসল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার পর হাওরাঞ্চলে দেখা দেয় মাছের মড়ক। কাঁচা ফসল পানির নিচে তলিয়ে পচন ধরে। এতে সমগ্র হাওরাঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ। পচা দুর্গন্ধে এসব এলাকার বাতাসেও গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। ফসলের পচনে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যায়। তার উপর ভারী বৃষ্টিপাত শেষে মেঘমুক্ত আকাশে প্রচ- দাবদাহ শুরু হওয়ায় গরমে মাছসহ পানিতে বসবাসকারী জলজ উদ্ভিদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় হাওরের পানি। বাঁচতে না পেরে হাওরের পানিতেই মরে ভাসতে থাকে মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, কেঁচো, জোঁকসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে ১ হাজার ২৭৬ মেট্রিক টন মাছ ও ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস মারা যাওয়ার কথা জানানো হলেও স্থানীয়দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও ৩০ হাজার হাঁস মরেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও গবাদি পশুর গো-খাদ্য নষ্ট হয়েছে আরো অন্তত হাজার কোটি টাকার। তার উপর দীর্ঘ মেয়াদী পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশংকাতো রয়েছেই।
শুরুটা হয়েছিল ১৯শে মার্চ থেকে। তখন আকাশে কালো মেঘের ধাবাধাবিতে বৃষ্টিপাত হলেও সুনামগঞ্জের নদনদীতে তেমন পানি ছিল না। তবে অব্যাহত বৃষ্টিপাত একনাগাড়ে চলতে থাকায় ২৯শে মার্চ থেকে তা প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করে। ভারি বৃষ্টিপাতের সাথে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল শুরু হয়। দু-এক দিনের মধ্যেই টইটম্বুর হয়ে যায় সবকটি নদনদী। আর কৃষকদের কপাল পুড়তে থাকে। ঢলের পানির ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত দুর্বল বাঁধ। বালির বাঁধের মতই একে একে ভাঙ্গতে থাকে ফসলরক্ষা বাঁধ। সুযোগ বুঝে বাঁধ থেকে সটকে যায় ঠিকাদার ও পিআইসিরা। তাদের স্থলে স্বেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসে ভুক্তভোগী কৃষকেরা। শুরু হয় বাঁধ রক্ষার প্রাণান্তকর লড়াই।
শুরুটা হয়েছিল তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪ ইউনিয়ন বেষ্টিত টাঙ্গুয়ার হাওর দিয়ে। এরপর আর কোন আশার আলো দেখা যায়নি। দেখার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়াইন হাওর, খরচার হাওর, চন্দ্র সোনার থাল, নলুয়া হাওর, টগার হাওর, ছায়ার হাওর, হালীর হাওরসহ দেশখ্যাত এসব বোরোর ভাণ্ডার ডুবতে শুরু করে। আর সপ্তাহান্তে একে একে সবই গেল জোয়ারের পানিতে। সর্বশেষ হাওর হিসেবে জামালগঞ্জের পাগনার হাওর দিয়ে এই দুর্যোগের সমাপ্তি ঘটে। আর মাছের মড়ক শুরু হয়েছিল সুনামগঞ্জ সদরদক্ষিণ সুনামগঞ্জ ছাতক উপজেলা বেষ্টিত দেখার হাওর থেকে। তারপর সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বিস্তৃত হাওরগুলোতে দেখা দেয় মাছের মড়কে মহামারি।
মাছের মড়কের কারণ পানিতে ইউরেনিয়াম না ফসলের পচন এ নিয়ে স্থানীয় অভিজ্ঞজন ও কৃষকদের মধ্যে নানা গুঞ্জন সমালোচনা শুরু হলে সুনামগঞ্জে তদন্তে আসেন একাধিক বিশেষজ্ঞদল। মাছের মড়কের জন্য প্রাথমিকভাবে ফসলের পচন, পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়া, অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যাওয়া ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারকে চিহ্নিত করেন। এত সব দুর্যোগ ও একের পর এক বিপর্যয়েও টনক নড়েনি সরকারের। সুনামগঞ্জের কৃষকদের ন্যায্য দাবি সুনামগঞ্জকে এখনও দুর্গত এলাকা ঘোষণা করেনি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
পাহাড়ি ঢলে শ্রীবরদীতে বোরো ধানের বিপুল ক্ষতি
শেরপুর সংবাদদাতা : প্রবল বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নতুন করে শেরপুরের সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী উপজেলার তিন ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়ন হলো খড়িয়া কাজীরচর, কুড়িকাহনীয়া ও গড়জরিপা। এসব ইউনিয়নের ১০ গ্রামের প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির উঠতি পাকা ও কাঁচা বোরো ধান পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত চারদিনের অবিরাম বর্ষণ ও সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ঝিনাইগাতী উপজেলার ছয়টি ও শ্রীবরদী উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। তলিয়ে যায় উঠতি বোরো ফসল। বিপুল পরিমাণ মাছ ভেসে গেছে ও গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন করে শ্রীবরদী উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ১০ গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এক হাজার হেক্টর জমির উঠতি পাকা ও কাঁচা বোরো ধান পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। শ্রীবরদী উপজেলার মাদারপুর গ্রামের কৃষক মাহমুদ আলী সাদা, সুজন মিয়া ও মো. আব্দুল খালেক অভিন্ন ভাষায় বলেন, বয়শা বিল এলাকায় প্রায় ছয়শত হেক্টর জমির কাঁচা-পাকা বোরো ধান পানির নীচে। অত্যাধিক জোকের কারণে ধান কাটার জন্য কোনো শ্রমিক পানিতে নামতে চাইছে না। তাই অধিকাংশ ধানই নষ্ট হয়ে যাবে। ঋণ করে লাগানো ধান গোলায় তুলতে না পারায় তাঁরা ঋণের টাকা পরিশোধ করবেন কীভাবে আর খাবেনই বা কি বললেন সাংবাদিকদের কাছে।

http://www.dailysangram.com/post/281309-