৪ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:১৩

খেলাপি ঋণের আধিক্যই প্রধান সমস্যা

খেলাপি ঋণের অঙ্ক দিন দিন বেড়েই চলছে। টাকা পরিশোধে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না খেলাপিরা। মূলত এ কারণেই অর্থ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে গুণগত মানের ঋণ বৃদ্ধিতে শ্লথগতি বিরাজ করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজেরাই এই সমস্যাগুলো শনাক্ত করে পৃথকভাবে তুলে ধরেছে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিপত্রে (এপিএ)। এছাড়া ব্যাংক খাতে অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় কম এবং মামলাজনিত কারণেও ঋণের অর্থ আদায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত শনিবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর এপিএ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

যদিও বহুজাতিক দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসাবে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দ্রুত কমাতে বলছে। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ ও বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে বলেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এপিএ নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো সমস্যার পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়, খেলাপিসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, টাকা আদায়ে চাপ দেওয়া হলে রিট মামলা দায়ের করার প্রবণতা, রিট ভ্যাকেট দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যা ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা হিসাবে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া অটোমেশনের কারণে হ্যাকিং ঝুঁকি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করা হয়।

প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রতি অর্থবছরের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জন্য ইতোমধ্যে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চারটি ব্যাংক চলতি অর্থবছরে মোট খেলাপি ঋণ থেকে ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এপিএতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি অর্থবছরের কর্মকাণ্ডের একটি পরিকল্পনা বা রূপরেখা দেওয়া হয়। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে কর্মসম্পাদন নামে প্রতিটি ব্যাংকের চুক্তি হয়। নতুন অর্থবছরের রূপরেখায় ব্যাংকগুলো তাদের প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরে। পাশাপাশি খেলাপি এবং অবলোপন ঋণ থেকে কত টাকা আদায় করবে, মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক, লোকসানি শাখা কমিয়ে আনাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ যে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা তা স্বীকার করে নিয়েছে সেটি ভালো। এর ফলোআপ হিসাবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে একটি সমস্যা হচ্ছে-খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে তারা উচ্চ আদালতে গিয়ে একটি রিট করে স্টে-অর্ডার নিয়ে আসে। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। আমি বহু আগেই বলেছি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মিলিতভাবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে সমস্যাগুলো কীভাবে দূর করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। শুধু ৩ মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। আর বিগত এক বছরে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার কোটি টাকা।

এপিএতে রাষ্ট্রায়ত্ত শীর্ষ সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণের অঙ্ক গত অর্থবছরের ১১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা থেকে চলতি অর্থবছরে ১১ হাজার ৫০০ কোটিতে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর শ্রেণিকৃত এবং অবলোপনকৃত ঋণ থেকে একই সময়ে ৫৬৫ কোটি টাকা আদায় করবে বলে জানিয়েছে। এ বছর ২৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

একইভাবে অগ্রণী ব্যাংক গত অর্থবছরের ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের অঙ্ক থেকে চলতি অর্থবছরে ১৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ সময় শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে ৭০০ কোটি টাকা এবং অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি রূপালী ব্যাংক বলেছে, গত অর্থবছরের শ্রেণিকৃত ঋণ ৯ হাজার ২৪০ কোটি থেকে ৯ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হবে। একই সময়ে ৪৫০ কোটি টাকা আদায় করা হবে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে। আর অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় করবে ১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে খেলাপি ঋণ ৯৫০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হবে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি ব্যাংকগুলো দিয়েছে, বিষয়টি ভালো। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে পালন করছে কিনা, তা ‘ব্যাংক টু ব্যাংক’ ধরে মনিটরিং করতে হবে। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকদের ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। আর যদি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, অবশ্যই ওই কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
এপিএ নথিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বলেছে, ব্যাংকের ভিত্তি দুর্বল। এক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে সেটি শক্তিশালী করা হবে। সেখানে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও অগ্রিম থেকে সুদ আদায়, ফি ও কমিশন থেকে আয় কমছে। এছাড়া ব্যাংকের সীমিত অপরাশেন এবং ঋণ ও আমানতের স্থিতি তুলনামূলক কম। এছাড়া খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩-এর সঙ্গে সংগতি রেখে মূলধন সংরক্ষণ পর্যাপ্তভাবে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি বেড়েই চলছে। সেখানে আরও বলা হয়, ঋণখেলাপিরা টাকা পরিশোধ করতে অনীহা দেখাচ্ছে। টাকা না দিয়ে উলটো মন্দ গ্রাহকরা আদালতে রিট মামলা দায়ের করে দিচ্ছে। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি রিট নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সিআইবি ইস্টে’ থাকার কারণে ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ত হারে সংরক্ষণ ও শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/691978