৪ জুলাই ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৪৪

প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি

-ড. মো. নূরুল আমিন


মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আসসালামু আলাইকুম
দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অব্যাহত অবনতি, হত্যা, গুম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জনপ্রশাসনের সীমাহীন অদক্ষতা ও নির্লিপ্ততা, সরকারি, বেসরকারি সকল খাতে বিরাজিত চরম হতাশা, সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় অনিশ্চয়তা এবং দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের জীবন যখন ওষ্ঠাগতপ্রায় তখন আমি আপনাকে এই খোলা চিঠিটির মাধ্যমে আমাদের জাতীয় জীবনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আপনার ব্যক্তিগত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। তবে মূল বিষয়ে আসার আগে আপনাকে কিছুটা ধন্যবাদ জানানো জরুরি বলে আমি মনে করি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একদশকের বেশী সময়ের আগে আপনি একটি ভাল কাজ করেছেন। আপনি আপনার মরহুম পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশ করে দেশব্যাপী নন্দিত হয়েছেন বলে আমি মনে করি। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেশ ও জাতির প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে কিছুটা হলেও পরিচিত হবার সুযোগ পাবে। বিগত ৪০ বছর ধরে আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের যে ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তাতে ১৯৭১ সালের পূর্বে আমরা যে একটা জাতি ছিলাম, আমাদের পূর্বপুরুষরা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং ভারতীয় বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যুগপৎভাবে সংগ্রাম করে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ বাস্তব সত্যটি সেখানে অনুপস্থিত ছিল এবং এখনো রয়েছে। আপনার পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই বিষয়টি বিধৃত হয়েছে এবং গ্রন্থটি প্রকাশ করে আপনি জোর করে ভুলিয়ে দেয়া এই সত্যটি দেশবাসী বিশেষ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জানবার সুযোগ করে দিয়েছেন। যারা পুস্তকটি পড়বে তারা বুঝতে পারবে কেন অবিভক্ত ভারতে হিন্দুদের সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমঅধিকার নিয়ে মুসলমানরা একত্রে থাকতে পারেনি এবং ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। পুস্তকটি প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন যে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে সংঘাতমুখর হয়ে উঠছে এবং সর্বত্র স্থিতিহীনতা আমাদের কাঙ্খিত শান্তি, সংহতিকে অনিশ্চিত করে তুলছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই সংকট উতরিয়ে আমরা গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবো কিনা এই মুহূর্তে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে আপনার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার উপর। প্রচুর সম্ভাবনা ও সমস্যাসম্পন্ন আমাদের এই প্রিয় দেশটির ভাগ্য এখন আপনার হাতে। আপনি ইচ্ছে করলে সকল প্রকার সংঘাত-শংকা অবিলম্বে দূর হয়ে যেতে পারে এবং এদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ একটি জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে দেশ ও সমাজকে অগ্রগতির শিখরে পৌঁছিয়ে দিতে পারে।

আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, জাতি হিসেবে আমরা দীর্ঘকাল ধরে ঐক্যহীনতা ও বিভক্তি সমস্যায় জর্জরিত। এ দেশে যাদের জন্ম, এদেশের আলো-বাতাসে যারা লালিত-পালিত, সরকারকে চৌকিদারী ট্যাক্স থেকে ভূমি রাজস্ব এবং কর শুল্ক পরিশোধ করেন তাদের সকলেই এদেশের নাগরিক এবং সমঅধিকার প্রাপ্তির যোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আপনার দলের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা এ কথাটি স্বীকার করেন না। তারা স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে দেশকে বিভক্ত করে ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছেন। আপনার মরহুম পিতা ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে যারা তার দলের অবস্থানকে সমর্থন করতে পারেননি তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। আপনি তাদের সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও করেছেন। একই মঞ্চে বক্তৃতা করেছেন। আপনার দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর অনুকূলে ভোট চেয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় যাবার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে তাদের সহযোগিতায় কোয়ালিশন সরকার গঠনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আদর্শগত ও কৌশলগত কারণে তারা আপনার দলকে সমর্থন না করে অন্য দলকে সমর্থন করেছে। এতে তারা শত্রু হয়ে যেতে পারেন না, না আপনার দলের, না দেশের, না স্বাধীনতার। একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ, স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দলীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কাউকে সমর্থন করা না করার অধিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই অংশ। আবার দলীয় আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে সংগঠিত করার বিষয়টিও গণতন্ত্রেরই কথা। এটা অপরাধ নয়। আপনি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের প্রধানমন্ত্রী, একাধিকবার হজ¦ ও ওমরাহ করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এ দেশের হক্কানী আলেম-উলামা এবং ইসলামী দলগুলোকে আপনার দল স্বাধীনতা বিরোধী ও জঙ্গী অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান পরিচালনা করছে। আপনার দলীয় নেতা-কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ জিহাদকে পরিহাসের বস্তুতে পরিণত করেই ক্ষান্ত হয়নি, সন্ত্রাসের প্রতিশব্দেও পরিণত করেছে। কুরআন হাদীস ও ইসলামী বই-পুস্তককে জিহাদী বই হিসেবে আখ্যায়িত করে সেগুলোর অবমাননা করছে। খ্যাতনামা আলেম-উলামাকে অপমান-অপদস্থ করছে। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী নেতৃবৃন্দকে চরম নির্যাতনের শিকার বানানো হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা আমার বিশ্বাস আপনি নিজেও সত্য বলে বিশ্বাস করেন না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের পাহাড় সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিচারের যে নাটক মঞ্চস্থ করেছে সে সম্পর্কে আপনি অবহিত নন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এতে আপনি বা আপনার দল কতটুকু লাভবান হচ্ছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আমি অনুরোধ করব। আপনার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং মন্ত্রিসভার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বেশ কিছুদিন আগে আপনার সরকার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, আপনার দল আওয়ামী লীগ নয়, বরং আপনার জোটের শরীক কমিউনিস্টরাই দেশ শাসন করছেন। আসলে আপনার সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মে তার এই মন্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। কমিউনিস্টরা আল্লাহয় বিশ্বাস করে না। তাদের আদর্শিক নেতা মার্কস, লেনিনের মতে ধর্ম হচ্ছে আফিম সদৃশ এবং আল্লাহ হচ্ছেন মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন। রাশিয়া, চীন, পূর্ব জার্মানীসহ ইউরোপ, এশিয়ার স্বৈরাচারী ও কম্যুনিস্ট শাসিত দেশগুলোতে তারা ধর্মকে উৎখাত করার জন্য লাখ লাখ ধার্মিক লোককে হত্যা করেছিল, ধর্মশালা, উপাসনালয়, মসজিদ, গির্জা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু কার্যত দেখা গেছে যে, ধর্ম ও ধার্মিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযান তাদের যত বেপরোয়া ও শক্তিশালী হয়েছে, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা-গুম যত তুঙ্গে উঠেছে, মানুষের ধর্ম-বিশ্বাস তত শাণিত হয়েছে। তারা ধর্ম বিশেষ করে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। আপনি ব্যাপকভাবে বিদেশ সফর করে থাকেন এবং কমিউনিস্ট শাসনামলে ডেং পূর্ববর্তী সময়ে চীনে ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই সম্যকভাবে অবহিত রয়েছেন। ত্রিশ বছর ধরে সেই দেশের কমিউনিস্টরা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করেছে, কিন্তু তাদের নির্মূল করতে পারেনি। সত্তুরের দশকের শেষের দিকে মাও সে তুং-এর পতনের পর ডেং ক্ষমতা গ্রহণ করে যখন ধর্মকে উন্মুক্ত করে দেন তখন দেখা গেলো যে, মুসলমানরা আবার সেখানে আরো শক্তিশালীভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। আপনি নিশ্চয়ই বেইজিং শহরে গিয়েছেন। চীনের এ রাজধানী নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হোটেল নভোটল এবং কূটনৈতিক জোনের মাঝামাঝি স্থানে একটি ইসলামিক কমপ্লেক্স রয়েছে যেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, হেফজখানাসহ মুসলমানদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আছে। এখানে একটি ইসলামী ব্যাংকও আছে। এবং ‘আল-ইমারত ঃ মারকাজে তেজারতে ইসলামী ব্যাংক বেইজিং” এই শিরোনামে একটি বিরাট সাইনবোর্ড যেকোন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৯৩ সালে এই কমপ্লেক্সটি আমার পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমি জানতে পেরেছি যে, চীনের মুসলমানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই ইসলামী ব্যাংক ও বাণিজ্যকেন্দ্রটি শতবর্ষের পুরনো এবং ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে তারা অন্যান্য ধর্মীয় কার্যাবলীসহ এই ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটিও পরিচালনা করেছে। কমিউনিস্টদের অত্যাচার তাদের দ্বীনী কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। একই অবস্থা সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের বেলায়ও প্রযোজ্য। তিউনিসিয়া ও মিসরের অবস্থা তো আমরা কয়েকদিন আগেই দেখলাম। দশকের পর দশক ধরে একটি ইসলামী দল অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যা-গুমের শিকার হলো কিন্তু জরুরী অবস্থায় মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়েও তারা তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। সামরিক শাসকদের শক্তিশালী গোয়েন্দা এবং পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাদের ঠেকানো যায়নি। সাধারণ মানুষ তাদের পক্ষে জেগে উঠেছে এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রথম সুযোগেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তাদের নির্বাচিত করেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও জুলুম-নির্যাতন এখানে হার মেনেছে, জালেম শাসকরা পালিয়েছে যদিও বৈরী বিশ^শক্তির সহায়তায় তারা ফিরে এসেছে। সারা দুনিয়া তাদের অভিনন্দন জানিয়েছে। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব বসন্তের প্রস্ফুটিত এই ফুলকে প্রথম অবজ্ঞা করেছিল সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কায়রোতে ছুটে এসে তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিল। আমি জানি না কথাটি সত্য কিনা। পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে দেখেছি মিসরের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের দেশগুলো অভিনন্দন জানালেও বাংলাদেশ নাকি জানায়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী এক সময় বাংলাদেশের বিদ্যমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আরব বসন্তের ন্যায় আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অভিনন্দন না জানানোর সাথে এর সম্পর্ক আছে কিনা আমি জানি না। তবে আমি মনে করি অভিনন্দন জানানোটা আমাদের জাতীয় শিষ্টাচারের অংশ ছিল, তা পরিত্যাগ করা ঠিক হয়নি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন।

এত কথা আমি কেন বললাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। আপনার সরকারের এই আমলে, আমি আগেই বলেছি, ইসলামী দলসমূহের উপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের জঙ্গী আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কেষ্টা বেটার ন্যায় সব অপরাধের জন্য তাদের দায়ী করা হচ্ছে এবং সেই অপরাধটা আপনার দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা করলেও। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আপনার দল আওয়ামী লীগ থেকেও পুরাতন একটি রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ইসলামিক প্রতিষ্ঠান। এই দলটির সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে আপনার মরহুম পিতা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে অংশ নিয়েছেন। আপনি নিজেও এর সাথে এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। তখন তারা যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন- এমন কথা আপনারা কখনো বলেননি। তাদের সাথে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততাও তখন দেখেননি। কিন্তু যখন দেখা গেলো যে, তারা আপনার দলের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত জোটে অংশ নিয়েছে, তাদের ভোটের পাল্লা ভারী হচ্ছে এবং সেনাসমর্থিত বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে আপনার দলের নেতৃবৃন্দ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে অভিযুক্ত হলেও জামায়াত নেতাদের ঐ ময়লা-আবর্জনা স্পর্শ করছে না এবং তারা বেচাকেনার সামগ্রীও নয়, তখন হঠাৎ করে প্রতিবেশী দেশের থিংক ট্যাংকসমূহ প্রমাদ গুণতে শুরু করলেন এবং বলতে থাকলেন যে, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনে জামায়াতপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করে নিতে পারে। এই অবস্থায় ভারতীয় জেনারেল এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি দল বাংলাদেশ সফর করলো এবং এর পরপরই এখানে যুদ্ধাপরাধের ধুয়া উঠতে শুরু হলো। এর আগে আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, গত ৪০ বছরে আপনার দল কিংবা অন্য কোন ফোরাম থেকে এই ধুয়াটি তোলা হয়নি। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, আজকে যাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে স্বাধীনতার পর কখনো তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোন অভিযোগ আনা হয়নি। যুদ্ধাপরাধী কিংবা তাদের সহযোগী দালালদের তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখন তাদের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে এটা অবাঞ্ছিত এবং অমানবিক। যে অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের যে ধারা পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, তাদের বিচারের আয়োজনটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক। আপনারা এই মিথ্যা প্রতিহিংসামূলক অভিযোগে তাদের চরম শাস্তি দিলেন।
আপনার জানা আছে যে, জামায়াতে ইসলামী একটি বৈধ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন থেকে যথাযথভাবে দলটি নিবন্ধন পেয়েছে। এই দলটি সংসদেও প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং দেশে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে তার স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের অনেককে গ্রেফতার করে এবং দলের আমীর, নায়েবে আমীর ও মহাসচিবসহ প্রতিভাবান নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত করে আপনার সরকার দলটিকে নেতৃত্বশূন্য ও পঙ্গু করে দিয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগরী দফতর পুলিশ খুলতে দিচ্ছে না। অফিস কর্মচারীরা কাজ করতে পারছেন না এবং বারবার পুলিশ হানা দিয়ে তাদের গ্রেফতার করছে। এই অবস্থা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনার অনুকূল কিনা তা ভেবে দেখার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, হামলা-মামলা ও জেল-জুলুম দিয়ে কোন দল বা রাজনৈতিক আদর্শকে ধ্বংস করা যায় না। আপনার দল আওয়ামী লীগ এর বড় সাক্ষী এবং বিগত ৬০ বছর ধরে একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে এটা আমারও বিশ্বাস। এই অবস্থায় নিজেকে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী এবং মানসকন্যা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আপনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করবেন এটা এদেশের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। স্বচ্ছ মনে বিষয়টি আপনি ভেবে দেখতে পারেন।

আমি জানি না, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সারাদেশে কী ঘটছে সে বিষয়ে আপনি সঠিক তথ্য পান কিনা। আপনার গোয়েন্দা বাহিনী সম্পর্কে অনেকের অনেক অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ বলে যে, ভুল তথ্য দিয়ে তারা আপনাকে বিভ্রান্ত করছে।
আপনার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এখন সন্ত্রাসের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে বলেন, এটি এখন একটি আতঙ্কের নাম। কয়েক বছর আগে সিলেটের শতাব্দী পুরাতন এমসি কলেজের ছাত্রাবাস তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। এই কলেজটিতে মেধার ভিত্তিতে ছাত্রাবাসে আসন বরাদ্দ হতো এবং এই মানদন্ডে ছাত্রশিবির বেশি আসন পেয়েছে। এটা তাদের অপরাধ হতে পারে না। কিন্তু এই বিষয়টিকে অপরাধ গণ্য করে ছাত্রলীগ এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটির ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিল। আপনার পুলিশ নিরপরাধ শিবির কর্মীদেরই গ্রেফতার করলো। অপরাধীদের ধারে-কাছেও গেল না। এতে আপনার বদনাম হচ্ছে, মন্ত্রী বা পুলিশ বাহিনীর নয়। এই বিষয়টি ভাবতে আমার অবাক লাগে। ছাত্রলীগের হাতে এখন অনেক অস্ত্র। তাদের পেছনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাকিং রয়েছে, রয়েছে সরকারি দল ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। এর আগে তারা সারাদেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলসমূহে ৫ শতাধিক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েছে এবং বেপরোয়াভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তারা সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। বহু খুন করেছে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা এখন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জে¦না ব্যভিচার, ভর্তি বাণিজ্যসহ অবৈধ অর্থ উপার্জনে জড়িয়ে পড়েছে। এই অবস্থা দেশের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি আপনার দলের জন্যও। কেননা ছাত্র সংগঠনই যেকোন দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের উৎস। এই ছাত্ররা যখন পয়সার ধান্ধায় অনাচারে লিপ্ত হয় তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। আপনার জানা না থাকার কথা নয় যে, সাম্প্রতিককালে সারাদেশে অপরাধীদের নৃশংসতা এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। শিশু এবং নারীর উপর এ নৃশংসতা বেশি প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। নিরীহ প্রাণী এবং গাছপালাও নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ডাকাতি করতে গিয়ে ৮ মাসের শিশুকে অপহরণ করা হচ্ছে, ৪/৫ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে, গরিব তরুণীকে অর্থ এবং প্রেমের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করে শুধু হত্যাই নয়, তার দেহকে ছাব্বিশ টুকরো করে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, শুধু টাকা আর সম্পত্তির লোভে মাকে বেঁধে রেখে তার সামনে যুবতী মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে, কচি শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে- না পেলে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে যে গৃহকর্তা বা গৃহকত্রীর নুন খেয়ে জীবন ধারণ করেছে, অর্থের লোভে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শত্রুতাবশত খামারের হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ বাগানের এতো সুন্দর গাছ নিষ্ঠুরভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে। এসব কাজ করতে দুর্বৃত্তরা যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। মেহেরবাণী করে এর কারণ খতিয়ে দেখুন। অপরাধীরা তখনই বেপরোয়া হয়, যখন তাদের প্রতি সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। দ্রব্যমূল্যের উধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। আপনার একজন মন্ত্রী বলছেন এর জন্য যে সিন্ডিকেন্ট দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পান, কেননা তারা দেশকে অচল করে দিতে পারে। আপনি এদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি হিসেবে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং এই আন্দোলন করতে গিয়ে আপনার দল হরতাল, অবরোধ দিয়ে দেশকে অচল করে দিয়েছিল। তৎকালীন সরকার এ ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত তা গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এর অধীনে নির্বাচনে আপনি দু’বার ক্ষমতায় এসেছেন এবং বিএনপি-জামায়াত জোট একবার ক্ষমতাসীন হয়েছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আপনি আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থাটি তুলে দিয়েছেন এবং এই ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য বিরোধী দলসমূহের আন্দোলনকে আপনার সরকার বরদাশতই করছেন না এবং সংবিধানে একটি ধারা জুড়ে দিয়ে সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ন্যায় অপরাধের শামিল বলে গণ্য করেছেন। সংশোধিত সংবিধানে আপনি দলীয় সরকারের অধীনে দলীয় এমপিদের বহাল রেখে দলীয় ছক অনুযায়ী নির্বাচনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন। ফলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলসমূহ এতে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ফলে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দেশ সংঘাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তা শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করছে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠায় আপনার যে অঙ্গীকার সেটা আমি আপনাকে আর স্মরণ করিয়ে দিতে চাই না।

আপনার দেশপ্রেম সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই এবং আমি মনে করি, দেশ সংঘাতমুখর হোক তা আপনি চান না। এই অবস্থায় রাজনীতি ও দলীয় নেতৃত্বের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে উঠে এসে আপনি রাষ্ট্রনায়কসুলভ বড় মন নিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা মূল্যায়ন করবেন এবং দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবেন। এ জন্যে প্রয়োজনবোধে আপনাকে হয়তো কিছুটা ছোট বা নমনীয় হতে হবে। তবে এই ছোট হওয়াটা আপনাকে অনেক বড় করবে বলে আমার বিশ্বাস। আপনার কাছে এই দীর্ঘ চিঠিটি লিখতে বাধ্য হয়েছি বলে আমি দুঃখিত। আমি আপনার দীর্ঘায়ু ও সাফল্য কামনা করি।

https://dailysangram.info/post/528783