৩ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১২:০১

সিলেট অঞ্চলে সাময়িক বন্যার শঙ্কা

বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানিও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি বাড়ায় গতকাল সুনামগঞ্জে নৌকাডুবিতে তিন ভাই-বোনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার বেশ কিছু নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা দেখা দিয়েছে।
আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটের নিম্নাঞ্চলেও স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে। তিস্তাপারের মানুষও বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বাড়ছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তত্সংলগ্ন উজানে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে।

ফলে এ অঞ্চলের সুরমা, পুরাতন সুরমা, জাদুকাটা, সারিগোয়াইন, খোয়াই, সোমেশ্বরী ও ভোগাই-কংস নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে। এতে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার কিছু কিছু নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে।

উজানে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় এ সময় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি দ্রুত বাড়তে পারে। আজ সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমা অতিক্রম করতে পারে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবার বিকেল ৩টায় সোমেশ্বরী নদী নেত্রকোনার কলমাকান্দা পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ১৬ সেন্টিমিটার এবং সুরমা নদী সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকায় এ সময় এখানে পানি বাড়বে। তবে এর পরই কমে যাবে। এ জন্য আমরা এই বন্যাকে স্বল্পমেয়াদি বলব। এটা দুই-তিন দিনের বেশি থাকবে না।
এ সময় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদীসংলগ্ন কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।’

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

আগামী মঙ্গল ও বুধবার বৃষ্টিপাতের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে পরের পাঁচ দিনে বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।

নৌকাডুবিতে তিন ভাই-বোনের মৃত্যু : সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী হাওরে গতকাল রবিবার নৌকাডুবিতে তিন ভাই-বোনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো তন্নি বেগম (১২), তান্নি বেগম (৮) ও রাহিম মিয়া (৪)।

স্থানীয়রা জানায়, বছরখানেক আগে দিনমজুর সোহেল মিয়া গোবিন্দগঞ্জের নিচু ভূমিতে ঘর বানান। কিন্তু গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তাঁর বাড়িতে পানি ঢুকে যায়। আশ্রয়ের সন্ধানে সোহেল মিয়া ও ঋণ নিতে তাঁর স্ত্রী বাড়ির বাইরে যান। কিন্তু পানি বাড়তে থাকায় তাঁদের বড় ছেলে নাঈম মিয়া তিন ভাই-বোনকে সঙ্গে নিয়ে একটি ভাঙা নৌকায় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু নৌকাটি পানিতে ডুবে তন্নি, তান্নি ও রাহিমের মৃত্যু হয়। পরে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, খবর পেয়েই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। নিহত তিন ভাই-বোনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ বন্ধ : টানা বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানির কারণে সুনামগঞ্জ শহরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সরাসরি যানবাহন চলাচল তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে উপজেলায় বন্যা দেখা দিতে পারে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি বলেন, ‘উপজেলায় এখনো বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।’

ত্রাণ নয়, বাঁধ চান যমুনাপারের মানুষ : যমুনা নদীর পানি বাড়ায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের যমুনা তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। ভাঙনে দিশাহারা হয়ে পড়েছে নদীপারের শত শত মানুষ। চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতভিটা, ঘরবাড়ি, ফসলি জমিসহ নানা স্থাপনা। নির্ঘুম রাত কাটছে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের। কেউ কেউ ঘরবাড়ি সরিয়ে নিলেও অনেকে সে সুযোগটুকুও পাচ্ছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার চারটি ইউনিয়নের যমুনা তীরবর্তী গোবিন্দাসী, কষ্টাপাড়া, ভালকুটিয়া, চিতুলিয়াপাড়া, খানুরবাড়ী, কোনাবাড়ী, মাটিকাটা, সিরাজকান্দি, পাটিতাপাড়া, সারপলশিয়া, নলশিয়া, ন্যাংড়া বাজার, রায়ের বাশালিয়া, বাসুদেবকোল, রামাইল, মেঘারপটল গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতভিটাসহ ফসলি জমি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. বেলাল হোসেন বলেন, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছে।

হবিগঞ্জে বাড়ছে নদ-নদীর পানি : হবিগঞ্জের খোয়াই, কুশিয়ারা ও কালনী নদীর পানি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির পাশাপাশি ভারতের উজানে প্রচণ্ড পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি বাড়ছে।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকেও পানি আসছে। ফলে কুশিয়ারা ও খোয়াই ছাড়াও জেলার সব নদীতেই দ্রুত গতিতে পানি বাড়ছে। এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে যায়নি।

বাড়ছে-কমছে তিস্তার পানি : উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় তিস্তা নদীর পানি কখনো বাড়ছে, আবার কখনো কমছে। এতে করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তিস্তাপারের মানুষজনের মাঝে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত কয়েক দিন থেকে উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তার পানি কখনো বাড়ছে, আবার কখনো কমছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসাউদ্দৌলা বলেন, কয়েক দিন থেকে তিস্তা নদীর পানি কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে। বর্তমানে তিস্তা নদীর পানি বিপত্সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নেত্রকোনায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে নেত্রকোনায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে। গতকাল দুপুরে জেলার উব্ধাখালি নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নদ-নদীর পানি বাড়লেও কোনো এলাকা এখনো প্লাবিত হয়নি।

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/03/1294998