২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:৩০

হাওরে কান্না থামছে না

কৃষক বন্দি দাদন জালে

অভাবের সময় প্রান্তিক চাষীদের মাঝে কোটি কোটি টাকা ছড়ানো হয়

ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে ভাটি এলাকার অধিকাংশ কৃষকের ঘরে হানা দেয় অভাব। বৈশাখের একমাত্র বোরো ফসল বছর পেরিয়ে আরেক বৈশাখ পার হতে চায় না। নতুন ফসল ঘরে তোলার আগেই কৃষকের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর’ অবস্থা তৈরি হয়। এ সুযোগটি লুফে নেয় দাদন ব্যবসায়ীরা। দালালদের মাধ্যমে তারা দু’হাতে টাকা বিলিয়ে কিনে নেয় প্রান্তিক চাষীদের। হাজার টাকায় তিন মণ ধান দেয়ার শর্তে টাকা ছড়ানো হয়। হাওরাঞ্চলে এভাবে দেয়া টাকার পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। এটা প্রায় প্রতিবছরের চিত্র। কাজেই ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। কিন্তু অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল ফসল ভাসিয়ে নেয়ায় সব হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে। দাদনের ভারে ন্যুয়ে পড়া প্রান্তিক চাষীর দিন কাটছে মহাজনের আতঙ্কে। দুর্যোগে মহাজনি ঋণ ও এনজিও ঋণের চাপে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে টাকা লগ্নি করে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে দাদন ব্যবসায়ীরা। মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা সুদসহ মহাজনের টাকা আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে।


সুনামগঞ্জ সদরের এমপি পীর ফজলুর রহমান মিজবাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো মধ্যস্বত্বভোগী যদি কৃষককে হয়রানি করে তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসনকেও এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে বলেন। ব্যাংক ঋণ আদায় স্থগিত নয়, এটা মওকুফের দাবি জানান তিনি। এমপি বলেন এনজিওর দেয়া ক্ষুদ্রঋণও মওকুফ করতে হবে।

দিরাই উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের এক ধান ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার প্রতিনিধিরা ত্রিশ লাখ টাকার ধান কেনার জন্য টাকা ছড়িয়েছে। জানি না কিভাবে টাকা ফেরত পাব। টাকা না পেলে আমি শেষ হয়ে যাব।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন গ্রামের প্রভাবশালী দালাল বা পাইকারদের হাতে সব মহাজন টাকা দেয়। আর পাইকাররা ফাল্গুন-চৈত্র মাসে চাহিদা অনুযায়ী এ টাকা কৃষকের হাতে অগ্রিম দিয়েছিল। প্রতি হাজারে তিন মণ বা আড়াই মণ হিসাবে এ ধান ঘরে ওঠার কথা ছিল বৈশাখ মাসে। কিন্তু আগাম বন্যায় সব শেষ। এরকম শত শত ধান ব্যবসায়ী পথে বসে গেছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগাম ধান কেনার প্রতিশ্রুতিতে হাওরাঞ্চলের কৃষকের হাতে এ ধরনের ঋণ শতকোটি টাকার কম নয়।’

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া বাজারের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, এলাকার একজন প্রভাবশালী চাতাল মিলের মালিক ৮ হাজার মণ ধান কিনতে এলাকার প্রভাবশালীদের মাধ্যমে অগ্রিম টাকা লগ্নি করেছিলেন। তার সবই শেষ হয়ে গেছে। এরকম বাস্তবতার মুখোমুখি প্রায় ৩শ’ চাতাল মালিক।

ধান নেই, মাছও নেই তাহলে কৃষক এই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবে জানতে চাইলে দিরাই-শাল্লার এমপি ড. জয়া সেনগুপ্তা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগী এসব ব্যবসায়ীকে আমি অনুরোধ করব তারা যেন অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়ান। কিভাবে কৃষক এ ঋণ পরিশোধ করবেন তা যেন বিবেচনায় নেয়া হয়। সর্বস্ব হারানো কৃষকের কাছে ঋণ পরিশোধের মতো সম্বল নেই। তাহলে তিনি কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন। তিনি বলেন, ‘সরকার কৃষিঋণ আদায় স্থগিত করেছে। এটা স্থগিত নয়, মওকুফ করতে হবে। আর মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে সরকারিভাবে বৈঠক করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।’

সরেজমিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে সাধারণ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে দাদনের আরও ভয়াবহ চিত্র। মাহতাবপুর গ্রামের হিমাংশু দাস বলেন, ‘নিজের ১৬ কেয়ার জমি চাষ করেছিলাম আমি। ৩০ হাজার টাকা দেড় গুণ সুদে নিয়েছিলাম। আমার ২ ছেলে। এক ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও এক ছেলে বিএ পড়ে।’ খেয়ে না খেয়ে হিমাংশু ছেলেদের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। ফসল হারিয়ে এবার তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ঋণ কিভাবে শোধ করবেন আর ছেলেদের পড়াশোনার খরচ কিভাবে জোগান দেবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। চাকুয়া গ্রামের সুজিত দাস পিন্টু বলেন, ‘৬০ হাজার টাকা দেড় গুণ সুদে এনে অন্যের ১৪ কেয়ার জমি বর্গা চাষ করেছিলাম।’ ক’দিন আগে হালের দুটি গরু ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন তিনি।

গোপালপুর গ্রামের যিশু বিশ্বাস তার স্ত্রী, স্কুলপড়–য়া ছেলে বিশ্বজিৎ, মেয়ে বিপাশা বিশ্বাস দিরাই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ও আরেক ছেলে রৌদ্র তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গার্মেন্টে কাজে যোগ দিয়েছেন।

সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সুনীল চন্দ্র দাস বলেন, হাওরে ধান নেই, মাছও নেই। এলাকায় তেমন কোনো কাজও নেই। এ কারণে এলাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতিমধ্যে অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। প্রতিদিন দিরাই সদরে ঢাকাগামী বাস ধরে এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে। অনেক ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে কাজের সন্ধানে বের হয়ে গেছে। আবার অনেকে অন্যস্থানে যেসব হাওরের ধান তলিয়ে যায়নি সেখানে ধান কাটা শ্রমিকের কাজ নিচ্ছে। চাকুয়া, গোপালপুর ও জয়পুরের ৯৫ ভাগ মানুষ এনজিও ও মহাজনি ঋণের জালে বন্দি। এবারের দুর্যোগে মহাজনি ঋণ ও এনজিও ঋণের চাপে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান ভুক্তভোগী এই কৃষক।

নিজের কোনো জমি নেই হারাণপুর গ্রামের কৃষ্ণদাসের। দেড় লাখ টাকা দেড় গুণ সুদে এনে ৩৬ কেয়ার জমি চাষ করেছিলেন। প্রতি কেয়ার জমি তিনি ৩ হাজার টাকা অগ্রিম দেন। পরিবারে ১৫ জন সদস্য। বৈশাখের ১৫ তারিখ ঋণের চাপ আসবে। কিভাবে ঋণ পরিশোধ করব, আর কিভাবে বাঁচব সেই চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। কামালপুর গ্রামের নরউত্তম দাস প্রতি কেয়ার পনেরোশ’ টাকা হিসাবে ১৭ কেয়ার জমি চাষ করেন। দেড় গুণ সুদে ২৫ হাজার টাকা ঋণ আনেন। সব হারিয়ে দিশেহারা নরউত্তম। মহাজনের ভয়ে তিনি এলাকা ছেড়েছেন। কারণ এবার ধান নেই, মাছও নেই, কোনো কাজও নেই। কী দিয়ে ঋণ শোধ করবেন? স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কিভাবে চলবেন, মহাজনকেই বা সামলাবেন কী দিয়ে? এসব ভেবেই এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে গাজীপুরে পাড়ি জমান।

চরনারচর গ্রামের সুশীল বৈদ্য প্রতি কেয়ার (৩০ শতাংশ) ৩ হাজার টাকা করে ১২ কেয়ার অন্যের জমি চাষ করেন। এ কারণে তাকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে। এর মধ্যে ব্র্যাক থেকে ২০ হাজার এবং গ্রামের সমিতি থেকে ৫ শতাংশ সুদে ৩০ হাজার টাকা নেন। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এর কিস্তি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ঋণতো মাফ হবে না। তাই সুশীল ভাবছেন গরু বিক্রি করবেন। কিন্তু গরুর বাজার যে সস্তা তাতে কোনো লাভ হবে কিনা এই ভেবেই দিন চলছে তার। ৮ সদস্যের সংসার কিভাবে চলবে আর ঋণই বা কিভাবে পরিশোধ করবেন এ নিয়ে চিন্তা করেই তিনি শেষ হয়ে যাচ্ছেন।

নোয়াগাঁও গ্রামের ইব্রাহিম মিয়ার নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের ২৪ কেয়ার (৭২০ শতক) জমি বর্গা নেন। প্রতি কেয়ার ৪ হাজার টাকা করে অগ্রিম দিতে গিয়ে তিনি ৮০ হাজার টাকা ঋণ নেন। ইব্রাহিম বলেন, গ্রামের দবির মিয়ার কাছ থেকে দেড় গুণ সুদে ২০ হাজার টাকা, একই হারে কামালপুর গ্রামের ছিপত আলীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ও ব্র্যাক থেকে আরও ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। ছেলের ছোট একটি দোকান ঋণের কিস্তির চাপ সামাল দিতে পারছে না। উল্টো এখন দোকানের ব্যবসাও বন্ধ।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/26/120245/