৩ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:৪২

বিদ্যুৎ গ্রিডের ক্ষমতাবর্ধন প্রকল্প আলসেমিতে আক্রান্ত!

প্রতিটি প্যাকেজের টেন্ডার ১ থেকে ২ বছর পর আহ্বান

অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের মতোই বিদ্যুতের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প আলসেমি রোগে আক্রান্ত। চার বছরের প্রকল্পে সোয়া পাঁচ বছরে গত এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৭০ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর পিজিসিবির তথ্য বলছে জুন পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। অনুমোদন পেলেও প্রতিটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বানে এক থেকে দুই বছর সময়ক্ষেপণ, প্রকল্পের কাজের ড্রয়িং ও ডিজাইন অনুমোদন যথাসময়ে না দেয়া, দফায় দফায় প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রকল্পের কাজে হস্তক্ষেপ ও বাধা দেয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হচ্ছে না। পরিকল্পনা কমিশন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ফলে বর্ধিত মেয়াদে এই প্রকল্প শেষ হবে সাড়ে ছয় বছরে। প্রায় চার শ’ কিলোমিটার লাইনের কাজ করতেই আধা যুগের বেশি সময় লাগছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সবার কাছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি দরকার। এ জন্য পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১৬ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশব্যাপী ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম একটি সঞ্চালনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) লিমিটেড একটি শক্তিশালী গ্রিডে নেটওয়ার্ক বিনির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের পরিবর্ধন এবং ক্ষমতাবর্ধন শীর্ষক প্রকল্পটির উদ্যোগ নেয়া হয়। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ অনুমোদন দেয়া হয় পাঁচ হাজার ৮০৩ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৬৮৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে তিন হাজার ৬৪২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের তহবিল থেকে ৪৭৮ কোটি ৭ লাখ টাকা জোগান দেয়া হবে। যেসব উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে সেগুলো হলো, মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলা। চট্টগ্রামের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, মিরসরাই, পটিয়া, হালিশহর, হাটহাজারী, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া এবং লোহাগাড়া উপজেলা। ফেনীর ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঁয়া ও সোনাগাজী উপজেলা। নোয়াখালীর নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ি এবং চাটখিল উপজেলা। কুমিল্লার কুমিল্লা সদর, দেবীদ্বার, দাউদকান্দি, মুরাদনগর, লাকসাম, বুড়িচং এবং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা। চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ এবং মতলব উপজেলা। লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মীপুর সদর এবং রামগঞ্জ উপজেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা। কক্সবাজারের কক্সবাজার সদর, চকরিয়া এবং রামু উপজেলা।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে, ১২ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ১৭৫ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ২৫৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, ২টি ৪০০ কেভি সাবস্টেশন, ২টি ২৩০ কেভি সাবস্টেশন, ১০টি ১৩২ কেভি সাবস্টেশন, ৬টি বে সম্প্রসারণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম উন্নতকরণ, ৮৬ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা।

জানা গেছে, অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ী প্রকল্পের মূল কার্যক্রম বা অঙ্গগুলোর মধ্যে প্যাকেজ-৩ এ সার্ভে, ভূমি অধিগ্রহণ ও রিকন্ডাক্টরিং কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন, ক্ষতিপূরণ, জিআইএস সাবস্টেশন এবং সঞ্চালন লাইন নির্মাণসহ অন্যান্য অঙ্গের কাজ চলমান রয়েছে। গত এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত চলমান কাজের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ, ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন ৬৮ শতাংশ, ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ৭৭.৭০ শতাংশ, ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ৭৫.৫০ শতাংশ, ৮০০ কেভি সাবস্টেশন (২টি) ১৮.৫০ শতাংশ, ২৩০ কেভি সাবস্টেশন (২টি) ৩৫ শতাংশ, ১৩২ কেভি সাবস্টেশন (১০টি) ৫০ শতাংশ, বে- সম্প্রসারণ (৬টি) ২০ শতাংশ, ক্ষতিপূরণ (৪৪৪.৮৪ কিলোমিটার) ৫০ শতাংশ এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্রয়ের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় সঞ্চালন লাইনের মোট ৯৫০টি টাওয়ারের মধ্যে এ পর্যন্ত ৯০৩টি টাওয়ারের ফাউন্ডেশন, ৭২৮টি পাইল ক্যাপ, ৬৩৫টি ইরেকশনের কাজ শেষ হয়েছে। ৪৪৪.০৬ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে ২০৬.৪৩ কিলোমিটার স্ট্রিংগিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া সরেজমিনের তথ্য বলছে, প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাই করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় একাধিক প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুতেই ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৬৭ জন জনবলের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৪ জন (প্রেষণ-৪৮ জন ও আউটসোর্সিং-৬ জন) পদায়ন করা হয়েছে। বাকি ১৩ জন (প্রেষণ) এখনো পদায়ন হয়নি। আইএমইডির প্রকল্প পরিদর্শনের সুপারিশগুলো প্রকল্প অফিস কর্তৃক বাস্তবায়নের নিমিত্তে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদফতর কর্তৃক প্রকল্পের আওতায় মোট ১৯টি অডিট আপত্তি প্রদান করা হয়েছে। ১৯টির মধ্যে ৮টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১১টি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়নি।

ডিপিপি অনুযায়ী ৮১ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই সম্পন্ন হয়েছে। পিজিসিবি কর্তৃক প্রেষণে নিয়োজিত দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল দ্বারা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে নির্মাণকাজের গুণগতমান নিশ্চিতকরণ সহজ হচ্ছে, যা প্রকল্পের অন্যতম সবল দিক। তবে প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডিপিপির নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দরপত্র আহবান করা হয়নি। সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার স্থাপনের জমির মালিককে এখনো শতভাগ ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করা হয়নি। প্রকল্পের অন্যতম ঝুঁকি হলো- বর্তমানে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা। এ ছাড়া বৈদেশিক সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, চুক্তি অনুযায়ী যে রেট শিডিউল ছিল তার থেকে বর্তমানে প্রতিদিন মালামালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় চুক্তি অনুযায়ী পূর্বের রেট শিডিউল অনুযায়ী কাজ করা খুবই কঠিন হবে এবং ভেরিয়েশনের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈদেশিক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পিজিসিবির এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুর রশিদ খানের সাথে গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সংস্থাটির ওয়েবসাইটের ২৬ জুনের সর্বশেষ তথ্য বলছে এ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। আর অর্থ ব্যয় হয়েছে ৪৪.৩০ শতাংশ।

আইএমইডির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডাটা ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড প্রকল্পটি সম্পর্কে বলছে, প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং বর্তমানে নির্মাণসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে, যা প্রকল্প ব্যয়ের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রভাবশালী বিভিন্ন গ্রুপের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ। বেশির ভাগ জায়গাতেই উপকেন্দ্রের মাটি ভরাটের সময় স্থানীয় জনগণের সাথে জটিলতার কারণে ২-৩ মাস পর কাজ শুরু হয়। এ ছাড়া, বিভিন্ন জায়গায় সঞ্চালন লাইন এবং উপকেন্দ্রের জমি হস্তান্তর জটিলতার কারণে ২-৩ মাস পর কাজ শুরু করতে হয়। প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের নিমিত্তে জমির মালিককে যথাসময়ে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/759354