২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৯:২৬

ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে

বিনা টেন্ডারে চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির প্রস্তাব

মানা হচ্ছে না সীমিত দরপত্রের নীতিমালাও * ব্যয় ১০ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা

টেন্ডার ছাড়াই ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চীনা কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব করেছে সেতু বিভাগ। কোম্পানির নাম চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি)। চীনা অর্থায়নে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে সীমিত দরপত্র আহ্বানের বিধান থাকলেও এক্ষেত্রে তাও মানা হয়নি। ‘জরুরি ভিত্তিতে’ নির্মাণ শুরুর কারণ দেখিয়ে জি-টু-জি ভিত্তিতে ‘সরাসরি ক্রয়’ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তাবটি অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৫ কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার বা ১০ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাছাই হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি হতো। কম বা বেশি হতে পারত প্রকল্প ব্যয়। কিন্তু টেন্ডার না করার কারণে ওই সুযোগ হাতছাড়া হল। তারা জানান, চীনা সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনুসৃতব্য সীমিত দরপত্রের নীতিমালা ও পদ্ধতিসংক্রান্ত একটি পরিপত্র ৯ মার্চ জারি করে সরকার। ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘চীনা অর্থায়নে সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হবে। তবে উভয় রাষ্ট্রের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যেমন অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বা অন্যান্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে সীমিত পর্যায়ে প্রয়োজনে ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।’ এক্ষেত্রে সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সুযোগ থাকলেও রহস্যজনকভাবে তা করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, যেই পরিপত্রে সীমিত দরপত্রের মাধ্যমে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের কথা উল্লেখ রয়েছে, সেই পরিপত্র জারির আগে সিএমসির সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়া এটি জি-টু-জি পদ্ধতিতে (সরকার টু সরকার) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব কারণেই সীমিত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।

জানা গেছে, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সার-সংক্ষেপ পাঠিয়েছে সেতু বিভাগ। এতে সরাসরি পদ্ধতিতে চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ...‘বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর এর ভিত্তিতে চীন সরকারের সংশ্লিষ্ট অর্থায়নকারী এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এ ক্ষেত্রে যথাসময়ে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরসহ নির্মাণ কাজে বিলম্ব হবে। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করা প্রয়োজন।’ ওই সার-সংক্ষেপে আরও বলা হয়েছে, চীন সরকার মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনোনয়ন প্রাপ্তির তারিখ থেকে দু’বছরের জন্য বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে সীমিত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। প্রস্তাবিত ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের জুন মাসে সিএমসিকে মনোনয়ন দেয় চীন সরকার। সে অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের সর্বশেষ সময়সীমা ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই।

সূত্র বলছে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ সাভার, আশুলিয়া ও ইপিজেড-সংলগ্ন শিল্প এলাকার যানজট নিরসন এবং দ্রুত যোগাযোগের সুবিধার্থে। এটি নির্মিত হলে ঢাকার সঙ্গে ৩০ জেলার সংযোগ স্থাপনকারী আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল-চন্দ্রা করিডোরে যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। আবার নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা বা চট্টগ্রামগামী ওই এলাকার যানবাহনকে ঢাকার যানজটের মধ্যে ঢুকতে হবে না। নানা জটিলতার কারণে প্রকল্পটি দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। পরে সিএমসির সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করে সেতু বিভাগ। এ প্রকল্পেও টেকনিক্যাল কমিটি নির্মাণ ব্যয়ের প্রস্তাব করেছিল ১২৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। পরে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে র্যাম্প সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়। তাই ‘স্কুপ অব ওয়ার্ক’ সংযোজন করে আরও ৭ কোটি ডলার ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের ব্যয় হবে ১৩৫ কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার।

সেতু বিভাগের তথ্যমতে, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ার স্ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল এবং বাংলাদেশের ডেভ কনসালট্যান্টস ও এসিই কনসালট্যান্টস। এতে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৩৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এক্সপ্রেসওয়েটিতে ওঠানামার র্যাম্প নির্মাণে ব্যয় হবে ১৮০ কোটি ৫৬ লাখ ও টোল প্লাজায় ১৪০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় নিচের ১৫ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি দুই লেনের সেতু নির্মাণ করতে হবে। এতে ব্যয় হবে ৭৭৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আর ভূগর্ভস্থ পরিষেবা সংযোগ স্থানান্তর ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে ব্যয় হবে ২৭০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এছাড়া নকশা প্রণয়নে ২০৭ কোটি ও নির্মাণ তত্ত্বাবধানে পরামর্শক ব্যয় হবে ১৩৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে (জমি অধিগ্রহণ ছাড়া) এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। তবে ৩৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত নেই। এটি যুক্ত হলে ব্যয় আরও ২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/26/120416/