২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৮:৪৩

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ

মেধা নয় লাইনই মুখ্য

একের পর এক বিস্ময়কর ঘটনা। মাস্টার্স পাস না করেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। বিতর্কিত নিয়োগের সর্বশেষ সংযোজন মতিয়ার রহমান। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতার কাছ থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যিনি বিপুল আলোচিত। মতিয়ার রহমান এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এগিয়ে যাচ্ছেন তরতর করে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে বিতর্ক একেবারে নতুন কিছু নয়। তবে হাল-আমলের বিপর্যয় হয়তো অতীতের সব রেকর্ডই ছাড়িয়ে গেছে। ছাত্ররাজনীতি মৃত থাকায় এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে মেধা এখন প্রধান বিবেচ্য নয়। মুখ্য বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকে পদপ্রার্থীর রাজনৈতিক লাইন। তিনি বা তার পরিবার কোন লাইনের লোক সেটাই দেখা হয় সবার আগে। একই লাইনের অনেক প্রার্থী পাওয়া গেলে অবশ্য তৈরি হয় কিছুটা ঝামেলা। এক্ষেত্রে দেখা হয় অন্য যোগ্যতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগও ভূমিকা রাখে নিয়োগের ক্ষেত্রে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নয়, যেন নিয়োগ হচ্ছেন ভোটার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা নির্বাচনে এইসব শিক্ষকের ভোট জয়-পরাজয়ে রাখছে নিয়ামক ভূমিকা। আর শ্রেণিকক্ষে ছাত্ররা হচ্ছেন বঞ্চিত। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেখানে শিক্ষক হওয়ার কথা সেখানে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যরা হচ্ছেন শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষেও অনেক সময় তারা পড়ছেন বিড়ম্বনায়। শিক্ষার্থীদের অনেক প্রশ্নেরই জবাব থাকে না তাদের কাছে। বুয়েট ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগেই কম-বেশি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নাম্বার দেয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময় ন্যায্যতা বজায় রাখা হয় না। শুধু শিক্ষক নিয়োগেই নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও প্রধান বিবেচ্য হয় লাইন। এক্ষেত্রে প্রধানত দেখা হয়, কে লাইনে কতটা সময় দেয়। অনেককেই পরামর্শ দেয়া হয়, আপনি আরো সময় দেন। শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক নিয়োগে লাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে অবশ্য রাজনীতি থেকেও অন্য লাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিবেচনায় নেয়া হয় পরিচয়, প্রভাব আর যোগাযোগকে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের চলতি ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে এ নিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাবিদরা পরামর্শ দিয়েছেন আশু ব্যবস্থার পরিবর্তনের। অস্ত্রবাজরা কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ মানবজমিনকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় মতিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় শিক্ষক হয়েছেন তা মোটেও কাম্য নয়। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে একজন অস্ত্রবাজ এভাবে শিক্ষক হবেন তা অগ্রহণযোগ্য, অনাকাঙ্ক্ষিত তা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই ব্যক্তি শিক্ষক হওয়ার মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে আঘাত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নিজস্ব নীতিমালা আছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। নতুন করে নীতিমালা দরকার। কিন্তু এই নীতিমালা কে কতটুকু মানলো সেটাই দেখার বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না। উনি অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এই ছবি খবরের কাগজে বের হয়েছে, দেশের মানুষ দেখেছে। এরপরও কীভাবে উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এভাবে অস্ত্রবাজরা শিক্ষক হলে এখানে একদিন শিক্ষার নয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হবে। একজন শিক্ষকও যদি নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাহলে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চল্লিশ বছরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ান।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের একটি চিত্র পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হকের দেয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি লিখেছেন, ‘আনিছ আর ওসমানী, দু’জনই আমার সরাসরি ছাত্র। ওদের আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পাইনি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পায়নি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পায়নি। দু’জনেরই রেজাল্ট ভালো, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, দু’জনই মিডিয়ায় সুনামের সঙ্গে কাজ করে পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছে। তাদের কাজকর্মের খোঁজখবর রাখতাম, মিডিয়ায় তারা খুব ভালো করছিল। বেশ কয়েক বছর পর যখন তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর নিয়োগ হলো, ৫/৬ জন করে নেয়া হলো, আমার বিবেচনায় প্রেফারেন্সের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ৫ জনের মধ্যে থাকার যোগ্যতা ওদের ছিল। সমস্যা একটা ছিল ওসমানীর, এসএসসি বা এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৪.৫ (নাকি ৪.০?) ছিল না। তবে ওসমানীরা যখন এসব পরীক্ষা দিতো, সেইসব বছরে, জিপিএ ৪.৫ পাওয়া হাওয়া খাওয়ার মতো সহজ ছিল না। পরে দেখলাম প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স স্টাডিজে নিয়োগের সময় এই বারটা উঠিয়ে নেয়া হলো। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো ওঠাতে-বসাতে পারে। কিন্তু ওসমানীর সময় এটা করা হয় নি। আনিছের অযোগ্যতা কী, আজও জানি না। সম্ভবত সে নিজেকে যথেষ্ট ‘প্রগ্রেসিভ’ প্রমাণ করতে পারেনি। আজ যখন আওয়ামী লীগ হেফাজতের সঙ্গে আপস করে, তখন প্রগ্রেসিভ সাজার ভান না করে সে ভালোই করেছে।
এ দু’জনের কথা বললাম, কারণ তারা স্পষ্টভাবে তাদের রেজাল্টজনিত গোল্ড মেডেল নিয়ে হাস্যরস করছে। অর্থাৎ তারা স্যাটায়ারের মধ্য দিয়ে বলতে পেরেছে যে তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। কারণ ইতিমধ্যে জানা গেছে ছাত্রলীগ নেতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিতর্কিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মতিয়ার ইবি জবি হয়ে ঢাবিতে এসে প্রমোশন পেয়ে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই দুজনের বাইরে বঞ্চিত মানুষ আরো আছেন। আমাদের ডিসিপ্লিনেই আছেন, তা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। অন্যান্য ডিসিপ্লিনে তো আছেনই। হয়তো সামনে কোনো সুযোগ এসে যেতেও পারে, এই আশায় তারা বঞ্চনার কথা বলতে পারছেন না। সেই অপেক্ষা তাদের করাই উচিত। মূল ব্যাপার হলো আনিছ ও ওসমানীকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে। এর দায়দায়িত্ব নিয়োগকর্তাদের। এরা দুজন আমার সাবেক ছাত্র, তাদের বঞ্চনার পেছনে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনোই দায় নেই। কারণ এইসব নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে আমি দূরে থাকি, দূরে রাখা হয়।’
এরআগে টিআইবি তার রিপোর্টে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় এন্ট্রি লেভেল প্রভাষক নিয়োগে ৩-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেন হয়। এছাড়াও ভিন্ন রাজনৈতিক বা অপছন্দের প্রার্থীর যোগ্যতার তথ্য গোপন রাখা আর পছন্দের প্রার্থীকে হাইলাইট করে আগে থেকেই তার ব্যাপারে বোঝাপড়া করে নেয়া, অপছন্দের প্রার্থীকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা মন্তব্য করে বিব্রত করা, শিক্ষক সমিতির প্রভাব, কোনো প্রার্থীর ব্যাপারে ‘নোট অব ডিসেন্ট’-কে গুরুত্ব না দেয়ার তথ্য পেয়েছে টিআইবি’র গবেষণায়। এছাড়া কোনো রকম যাচাই ছাড়াই সিন্ডিকেট কর্তৃক নিয়োগ অনুমোদন, ভোট বাড়াতে নিয়োগ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আঞ্চলিকতা, স্বজনপ্রীতি, ধর্মীয় পরিচয় ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ প্রভাষক নিয়োগকে প্রভাবিত করছে। এসবের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবীদের বঞ্চিত করে তুলনামূলক কম মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে শিক্ষাদানসহ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। টিআইবি বলছে, শিক্ষক পর্যায়ে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগের জন্য পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা নাই, সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও তাদের অভিপ্রায়ে নিয়োগ হয়, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও সিন্ডিকেটের প্রধান ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগ কার্যক্রম প্রভাবিত করে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, প্রার্থীর আবেদনপত্র গায়েব করে দেয়া হয়েছে। এমনকি নিয়োগে পরীক্ষা সংক্রান্ত কয়জন আবেদন করেছে, কার কী যোগ্যতা অন্য আরেকজন প্রার্থীকে জানতে দেয়া হয় না।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63050