২৯ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৮:৫১

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মলিন মুখ

পাঁচ বছর বয়সী মরিয়ম আক্তার। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। মলিন হয়ে আছে তার মুখ। এক হাতে তার ক্যানোলা দেয়া। হাসপাতালের বেডে বসে ছোট বোনের সঙ্গে মোবাইলে গেম খেলছে। আবার কখনো শুয়ে দুই বোনে কার্টুন দেখছে। কখনো গল্প করছে ঈদকে ঘিরে। পাশেই বসে আছেন তাদের মা রুমা বেগম। তিনি রোববার ডেঙ্গু আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগের ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে ভর্তি।

একই বেডে ভর্তি চাঁদপুর থেকে আসা ডেঙ্গু আক্রান্ত আফরিনা আক্তার (৫)। সেও তার মায়ের মোবাইলে শুয়ে শুয়ে কার্টুন দেখছে। আফরিনা ঈদের কেনা নতুন পোশাক পরেই রয়েছে হাসপাতালে বেডে। মরিয়ম আক্তারের মা রুমা বেগম বলেন, ঢাকার জুরাইন থেকে এসেছি। আমার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। গত রোববার হাসপাতালে মেয়েকে ভর্তি করা হয়। ২১ তারিখ রাতে মেয়ের প্রচণ্ড জ্বর আসে। পরের দিন এলাকার একটি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। সেখানে পজেটিভ আসে। এরপর রোববার মেয়েকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি।

তিনি বলেন, ঈদে তো আনন্দ অবশ্যই থাকে। এখন তো বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তা। আগে বাচ্চা সুস্থ হবে তারপর কোরবানির আনন্দ করবো। দুই মেয়েকে নিয়ে এখন হাসাপাতলে আছি। দুই মেয়ে মিলে ঈদের গল্প করছে, খেলছে।

শুধু মরিয়ম আক্তার নন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের শিশু ওয়ার্ডের সরজমিন গিয়ে দেখা যায় অসংখ্য ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। বিশেষ করে ঈদের আনন্দ তাদের মনে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অনেকের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আগে ঈদের নতুন পোশাক কেনা হয়েছিল। সেগুলো কেউ পরছে, আবার কেউ বা হাসপাতালে এনে রেখেছে ঈদের দিন পরার জন্য। কেউবা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙাচ্ছে। তবে সঙ্গে থাকা মা-বাবা স্বজনদের মুখে নেই হাসি।

সূত্র জানায়, ঢামেকের জরুরি বিভাগের ২০৫, ২০৬, ২০৮, ২০৯, ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। এরমধ্যে ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে ৪ জন শিশু। ২০৯ নম্বর ওয়ার্ডে ১৯টি বেড। সেখানে অন্যান্য রোগী মিলে ৫০ জনের মতো ভর্তি রয়েছে। এরমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ৮ জন।

ঢামেকের নতুন ভবনে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ৬ষ্ঠ তলার ৬০১, ৬০২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে পুরুষ এবং অষ্টম তলার ৮০১, ৮০২ মেডিসিন ওয়ার্ডে নারী রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এখানে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৭ জন।

২০৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে ভর্তি আফরিনা আক্তার (৫)। তার মা নাজমা আক্তার বলেন, আমি চাঁদপুর থেকে এসেছি। আজ ১৩ দিন ধরে মেয়ের জ্বর। জ্বর কমছেই না। এখানে রোববার ভর্তি হয়েছি। আমি আর আমার ছেলে এখানে এসেছি। কোরবানির ঈদটা একটু স্পেশালই থাকে। বাড়িতে যারা আছে তাদেরও ঈদের দিনে মন খারাপ থাকবে। আমার মেয়ে তো ঈদের নতুন জামা এখনই পরে রয়েছে। এখন চুরি, মেহেদি কিনে দিতে বলছে। এলাকার হাসপাতালে থাকতে জ্বরটা একটু বেশি ছিল। এখন কিছুটা কমেছে। এখান থেকেই মেয়েকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই। এরপর বাড়িতে গিয়ে ঈদের আনন্দ করবো।

রুমানা বেগম বলেন, সোমবার মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। শনিবার থেকে মেয়ের জ্বর শুরু হয়। এরপর জ্বর একটু কমে। একদিন পর মেয়ের খিচুনি ওঠে। এরপর তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানে এসে ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। ঢাকার আনন্দ বাজারে ভাড়া থাকি। আমার স্বামী বঙ্গবাজারে ব্যবসা করেন। রোজার ঈদে অনেক স্বপ্ন ছিল সন্তানদের নিয়ে আনন্দ করবো কিন্তু তখনও আগুন লেগে সে আনন্দ আর করা হয়নি। এইবার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো। তাকে নিয়ে ঈদের দিনটা হাসপাতালেই কাটবে। দুইটি দোকান পুড়ে যাওয়ায় সে সময়ও কোনো কেনাকাটা করে দিতে পারিনি বাচ্চাদের। এই কোরবানির ঈদে বাচ্চাদের জন্য পোশাক কিনেছি কিন্তু হাসপাতালে থেকে সে আনন্দ আর কীভাবে হবে। এত সখ করে জামা-কাপড় কিনেছি বাচ্চাদের পরাবো, বাইরে নিয়ে ঘুরতে যাবো।

রোজিনা বেগম বলেন, আমার জান্নাতুল মারিয়মের ১১ তারিখ থেকে জ্বর। তখন বংশালে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে ডেঙ্গু ধরা পড়েনি। তখন জ্বর ভালো হয়ে যায়। এরপর দুই-তিন দিন পর আবার জ্বর আসে। তখন ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। সে সময় ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়। তখন ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মেয়ের প্লাটিলেট একদম কমে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে আইসিইউতে রাখা হতে পারে। সোমবার ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিবছর দুই ঈদে সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর যাই। সেখানে কোরবানি দেই। এইবার কোরবানির জন্য একটা খাসি কেনা হয়েছে। ছেলেদের পাঠিয়ে দিয়েছি সেখানে। এখন মেয়ে যদি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে আমরাও যেতে পারবো। আর যদি না হয় তাহলে হাসপাতালে ঈদ কাটাতে হবে। ঈদের দিনে সবার একটা আশা থাকে গ্রামে সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ করবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আগে আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ করে তোলা উচিত। দুই ছেলে আর এক মেয়ে আমার। আমার স্বামী আরমানিটোলায় লোহার ব্যবসা করে। মেয়ের শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। কিছুই খেতে চাচ্ছে না। ওই এলাকায় মশা অনেক বাড়ছে। আগে দেখতাম পরিষ্কার করতো কিন্তু সেটি এখন দেখা যায় না।

২০৮ নম্বর ওয়ার্ডে মরিয়মের পাশের বেডেই ভর্তি সাদিয়া (৭)। হঠাৎ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে সে। ঈদের কথা মনে করে তার বাবাকে নতুন জামা নিয়ে আসতে বলেছে। হাত মেহেদি রাঙানো। সালমা বেগম বলেন, বরিশাল থেকে এসেছি। মেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন অনেক বেশি অসুস্থ। যতক্ষণ না সুস্থ হবে ততক্ষণ আর বাড়িতে যাওয়া হবে না। বাড়িতে কোরবানির জন্য গরু কেনা হয়েছে। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটি তার বাবাকে ফোন দিয়ে বলছে ঈদের নতুন সুন্দর জামা নিয়ে আসার জন্য। ওর বাবা ঈদের জামা নিয়ে এসেছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ডা. নাজিফা রেজা মানবজমিনকে বলেন, এই ওয়ার্ডে ৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। রোগীদের অবস্থা খারাপ হলেই হাসপাতালে আসে। পেটে ব্যথা, বমি বেশি হয়। তখন হাত-পায়ে পানি চলে আসে। তখন চিকিৎসার ক্ষেত্রও জটিল হয়ে যায়। এখানে ২ জন শিশু রোগী এসেছে তাদের ২ জনেরই ফুসফুসে পানি চলে এসেছে। লিভার বড় হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ছুটি অলরেডি শুরু হয়ে গিয়েছে। সিডিউল করে ডিউিটি করা হচ্ছে। রোগীদের সেবা দেয়ার মধ্যেই আমাদের ঈদের আনন্দ খুঁজে পাবো।

https://mzamin.com/news.php?news=62473