২৭ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:৫৩

কোরবানির পশুহাটে মধ্যবিত্তের হাহাকার

- লাখ টাকার নিচে গরু নেই

রাজধানীর কোরবানির পশুরহাটে প্রচুর গরু এসেছে। এর বেশির ভাগই দেশীয় গরু যা পরিকল্পিত উপায়ে মোটাতাজা করা। গরু দেখতেও সুন্দর। কিন্তু দাম চড়া। হাটে লাখ টাকার নিচে গরু নেই। যেগুলো আছে সেগুলোর বেশির ভাগই ক্রেতাদের পছন্দ নয়। আর বেশির ভাগ মাঝারি গরুর দাম দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে। এর চেয়েও বেশি দামের গরু আছে। দাম ছয় লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে। ফলে কোরবানির পশুরহাটে মধ্যবিত্ত ক্রেতারা হাপিত্তেশ করছেন। লাখ টাকা দামের ছোট গরু কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

গতকাল মতিঝিল-কমলাপুরের লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবের হাটে দেখা যায়, প্রচুর গরু এসেছে। অনেক বেশি বড় গরু যেমন আছে, তেমনি একেবারে ছোট আকারের গরুও আছে। তবে দাম চড়া। একেবারে মিনি সাইজের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। যে গরুতে দুই মণ গোশত হওয়াও কষ্টকর। আর তিন মণ ওজনের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে এক লাখ ২০ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা।

কমলাপুরে গরু কিনতে এসে অসহায়ের মতো ঘুরছিলেন আরামবাগের মহসিন। বাজারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত তিনি। জানালেন, বাজেটের চেয়ে দামের বিস্তর ফারাকের কথা। একজন সাধারণ চাকরিজীবী মহসিন। বেতন-বোনাসের টাকার মধ্যেই কোরবানির পশু কেনার বাজেট করতে হয়। এবার আর সেই বাজেটে কুলোচ্ছে না। গতবারের চেয়ে অনেক বেড়েছে পশুর দাম। মহসিন জানান, এবার একটা ছোট গরুর দামও চাওয়া হচ্ছে এক লাখ টাকা। যাতে তিন মণ গোশত হবে। সে হিসেবে প্রতি কেজির দাম পড়বে প্রায় এক হাজার টাকা।

একই অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন শান্তি নগরের জাফর আহমদ। তিনি জানালেন মোটামুটি পছন্দের একটা গরু কিনতে হলেও লাখ টাকার বেশি গুনতে হচ্ছে। তার ভাষ্য, গত বছর যে গুরুর দাম ছিল ৮০ হাজার টাকা, এবার তার দাম এক লাখের বেশি। আর দরদাম করেও লাভ হচ্ছে না। বিক্রেতা যা চাইছেন তা থেকে সরছেন না। এতে করে এবার গরু কেনা দায় হয়ে গেছে।

মহসিন-জাফরদের মতো অনেকেই গরু কিনতে এসে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছিলেন। হাটের এ মাথা থেকে ওমাথায় ঘুরছেন। কিন্তু গরু কেনার সাধ্য হয়ে উঠছে না। তাদের ভাষ্য, কোরবানির পশুর হাট সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। যার কারণে এবার গরুর যে দাম তা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। অন্য দিকে গরু ছাড়া খাসির দামও অনেক বেশি। বলতে গেলে ২০ হাজার টাকার কমে খাসি নেই বললেই চলে।

অন্য দিকে এবার কোরবানির পশুর দাম অতিরিক্ত স্বীকার করে বিক্রেতারা বলছেন, গরুর খাদ্যের দামসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়েছে। ফলে তারা চাইলেও কম দামে পশু বিক্রি করতে পারছেন না।

বড়ো গরুর চেয়ে ছোট গরুর চাহিদা বেশি জানিয়ে পাইকাররা জানান, মধ্যবিত্তের মধ্যে বেশির ভাগের পছন্দ ছোট গরু। কিন্তু এবার দাম বেশি হওয়াতে অনেকে গরু না কিনে বাজেট সঙ্কুুলানে খাসি কিনছেন। আবার অনেকে আগে একটি গরু দিলেও এবার ভাগে কুরবানি দিচ্ছেন। আবার অনেকে সাংসারিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজেট কমিয়েছেন।

মুগদার বাসিন্দা আহমেদুল কবির জাকির বলেন, এখন সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার পরও প্রতি বছর পশু কুরবানি দিয়ে থাকি। এ বছরও দেয়ার নিয়ত করেছি। এ জন্য গত বছরের চেয়ে বাজেট কমাতে হচ্ছে। কিন্তু হাটে দেখছি উল্টো দাম গত বারের চেয়ে আরো বেড়েছে। বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া শিশুদের লেখাপড়াসহ সব ধরনের খরচ বেড়েছে। এ জন্য গতবার একটি গরু দিলেও এবার কয়েকজন মিলে ভাগে কোরবানি দেয়ার পরিকল্পনা করেছি।

বেসরকারি চাকরিজীবী মো: এমরান হোসেন বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে গরু কোরবানি দিয়ে থাকি। গত বছর দু’টি ভাগে দিয়েছিলাম। এবার এক ভাগ দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, গরুর দাম অনেক বেড়েছে। এর সাথে জীবনযাত্রার সব ধরনের ব্যয় বেড়েছে। খাদ্য পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে শিশুর স্কুলের খরচও।

বাসাবো কদমতলায় একটি ফর্মেসি দিয়েছেন হারুন অর রশীদ। আগে কয়েক ভাই মিলে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। কিন্তু নানা কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন তিনি। হারুন জানান, আগে এক সময় গরু কোরবানি দিলেও এবার দিতে পারছেন না।

পশুর হাটে অতিরিক্ত হাসিল নিলে কঠোর ব্যবস্থা : র‌্যাব
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কোরবানির পশুর হাটগুলোতে অতিরিক্ত হাসিল আদায় করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। গতকাল সোমবার দুপুরে গাবতলী পশুর হাটে সাংবাদিকদের এ কথা জানান র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, পশুর হাটগুলোতে হাসিল ঘর রয়েছে। অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন, অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের অভিযোগ এসেছে। হাটগুলোতে আমাদের মোবাইল টিম কাজ করছে। অতিরিক্ত হাসিল নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, এবারো আমরা কোরবানির হাটকেন্দ্রিক বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। স্বনামধন্য যে হাটগুলো রয়েছে সেখানে হাট পরিচালনা কমিটির সাথে সমন্বয় করে আমরা কন্ট্রোল রুম ও ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করেছি। তিনি বলেন, কোরবানির পশু বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম উপায়ে রাসায়নিক দ্রব্য খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ করে অথবা অস্বাস্থ্যকর গবাদি পশু বিক্রি করেন। এসবের বিরুদ্ধে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায়, ভেটেরেনারি ডাক্তারের সমন্বয়ে র‌্যাব একটি টিম গঠন করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। বিভিন্ন হাটে এই টিম পর্যবেক্ষণে যাচ্ছে। সকাল থেকে গাবতলী হাটেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা ১৫ জন ব্যবসায়ীকে সতর্ক করেছি।

কোরবানির হাটকেন্দ্রিক দালাল অজ্ঞান পার্টি মলম পার্টি প্রতারক চক্র ও জাল টাকা কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। রোববার রাত থেকে হাটকেন্দ্রিক অভিযানে প্রতারণা, ছিনতাইয়ে জড়িত ২০ জনকে আমরা আটক করেছি।

কমান্ডার মঈন বলেন, কোরবানির হাটকেন্দ্রিক প্রচুর টাকার নগদ লেনদেন হয়। যেখানে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী জাল টাকা নিয়ে হাটে আসেন, লেনদেনের চেষ্টা করেন। এই হাটে আমরা জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন র‌্যাব কন্ট্রোল রুমে রেখেছি। আমরা কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে ৫০ এর বেশি কারবারিকে আটক করেছি, যারা জাল টাকা কারবারে জড়িত। ৫০ লক্ষাধিক টাকার জাল নোট জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, অনলাইনে অনেকে কোরবানির পশু কেনাবেচা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই অনলাইনে পশু কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে কেউ যাতে প্রতারণার শিকার না হন সেজন্য র‌্যাবের সাইবার টিম কাজ করছে। বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় কোরবানি-পরবর্তী চামড়ার সঠিক মূল্য পান না প্রান্তিক কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেন। আমি তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, আমাদের গোয়েন্দা শাখার একাধিক টিম কাজ করছে। আমরা বেশ কিছু তথ্য ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছি। চামড়া বেচাকেনার সিন্ডিকেট করলে আমরা আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ইতোমধ্যে মহাখালী ও সাভারে আমাদের গোয়েন্দা টিম অভিযান পরিচালনা করে দালালচক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/758484