২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৮:২৭

প্রতিরাবিষয়ক এমওইউগুলোর কথা

সংবিধান ও রাজনীতি

|| সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক ||

অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের সংশ্লিষ্টতা
গত সপ্তাহের লেখার শিরোনাম ছিল ‘প্রতিরাবিষয়ক এমওইউ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত কথা’। গত সপ্তাহের লেখার সর্বশেষ কথাটিকে আজকের লেখার প্রথম কথা বানাব। কথাটি ছিল : ‘অবশ্যই লিখতে হবে তথা ব্যাখ্যা করতে হবে, আমরা যারা অবসরপ্রাপ্ত, এ বিষয়ে আমাদের চিন্তাচেতনা প্রকাশের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?’ প্রতিরা চুক্তি নিয়ে লেখালেখি বা টেলিভিশনে বলাবলি আমি একা করছি না; অনেক বর্তমান বা সাবেক অধ্যাপক, অনেক সাবেক কূটনীতিবিদ, অনেক কলাম লেখক, অনেক সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা, অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এ ধরনের লেখালেখি করছেন। লেখালেখি অবশ্যই প-েবিপে আছে। কয়েকটি মাত্র নাম উল্লেখ করছি। অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক তারেক সামছুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদুল হাসান, কলাম লেখক আভিয়া নাহরিন, গোলাম মাওলা রনি, কামাল আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মনিরুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ পিএসসি প্রমুখ। পত্রিকা পাঠক বা টিভি দর্শকদের কাছ থেকে সব সুপরিচিত ব্যক্তিদের কাছেই অনুরোধ এবং আবদার থাকছে : কিছু বলেন, কিছু লেখেন। ডাক্তারেরা বা আইনজীবীরা যত দিন সম্ভব তত দিন তাদের পেশাগত উৎকর্ষতা বজায় রাখেন। কারণ, উৎকর্ষতা না থাকলে রোগী বা কায়েন্ট আসবে না। সামরিক পেশা ডাক্তার বা অ্যাডভোকেটদের মতো নয় এটি যেমন সত্য, তেমন এটিও সত্য যে, একবিংশ শতাব্দীতে সামরিক লেখাপড়ার একটি বিরাট অংশ এখন সামরিক বাহিনীর বাইরের বিশ্ব বা মানুষের জন্য উন্মুক্ত। কিছু কিছু জিনিস অবশ্যই গোপন এবং সাম্প্রতিকতম (ইংরেজি পরিভাষায় : লেটেস্ট অ্যান্ড কারেন্ট) যেগুলো আমার বা আমার মতো অবসরপ্রাপ্তদের হালনাগাদ থাকবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা যারা অবসরপ্রাপ্ত তাদের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। শুধু অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেলের সংখ্যাই ডাক্তারসহ ১১৫ জনের বেশি। এটি জোয়ারের পানির মতো। এক দিকে কিছুসংখ্যক বুড়ো হচ্ছেন, নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন, অসুস্থ হচ্ছেন এবং ক্রমান্বয়ে আল্লাহর মেহমান হচ্ছেন। অপর দিকে, চাকরি শেষ করেই অথবা শেষ না করেই নিজ ইচ্ছায়, নতুন নতুন ব্যক্তি অবসরপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।
জ্ঞানচর্চার পরিবেশ আছে
আমি ইবরাহিম ২০ বছর আগের অবসরপ্রাপ্ত হতে পারি, কিন্তু আরেকজন বা অনেক মেজর জেনারেল বা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বা কর্নেল বা মেজর আছেন, যিনি ১২ মাস বা ১০ মাস বা চার মাস আগে রিটায়ার করেছেন। হালকা মেজাজেই বলি, চাকরির মেয়াদ পূর্ণ করে সসম্মানে অবসরে গিয়েছেন এরকম লেটেস্ট রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল যিনি, তিনি আমার থেকে বয়সে ১০-১২ বছর কনিষ্ঠ, কিন্তু তিনি কোনোমতেই জ্ঞানে আমার থেকে ১০-১২ বছরের কনিষ্ঠ হবেন এমন ধারণা করা উচিত নয়; বরং ধারণা করতে হবে যে যতই সাম্প্রতিকতম অবসরপ্রাপ্ত, ততই তিনি সামরিক বিদ্যা ও পেশার সাথে হালনাগাদ বেশি। বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্তদের সমাজে যেই অসুবিধাটা ১৯৭২-৭৩ সালে ছিল বা ’৮২-৮৩তেও কিছুটা ছিল, এমনকি ’৯২-৯৩তেও কিছুটা ছিল, সেই অসুবিধাটা এখন আল্লাহর রহমতে নেই; অর্থাৎ অবসরপ্রাপ্তদের জগতে মেধা ও জ্ঞানের চর্চা উজ্জ্বলভাবে আছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, অবসরের পর ২০০৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি লেখাপড়ার জগতে, এনজিওদের জগতে, নিরাপত্তাবিষয়ক আলোচনার জগতে দেশে-বিদেশে ব্যস্ত ছিলাম। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মাত্র প্রত্যভাবে রাজনীতি করছি। আমরা যারা অবসরপ্রাপ্ত, আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন। অবসরপ্রাপ্তরা দেশে এবং বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। অনেকেই সাহিত্য চর্চা করেন, অনেকেই সাংবাদিকতা করেন, অনেকে আইটি জগতে আছেন, অনেকেই কর্পোরেট জগতে উচ্চ মর্যাদায় আছেন। ফেসবুক এবং ইমেইল মানুষকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ সব কিছু মনিটর বা পর্যবেণ করে। অবসরপ্রাপ্তরা, চাকরিরতদের জন্য সম্পূরক শক্তি। দেশের খেদমতই উভয়ের অংশের অফিসারদের জন্য কাক্সিত ল্য। তবে যারা চাকরিরত তাদের জন্য খুবই পুরনো একটি বাংলা আপ্তবাক্য প্রযোজ্যÑ বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। অর্থাৎ চাকরিরতরা চাকরির শর্তের কারণে হোক বা পরিবেশের অভাবে হোক, অনেক কিছুতেই মন্তব্য করতে পারেন না। তবে পলিটিসাইজেশন বা রাজনীতিকায়ন নামের যেই শব্দ বা প্রক্রিয়া বিদ্যমান, সেটিও আমরা পুরোপুরি অবহেলা করতে পারি না; আট বছর সময়, মোটামুটি একটি রাজনৈতিক সরকারের প্রতি ‘এক্সট্রা-অনুগত’ পেশাজীবী জেনারেশন সৃষ্টি হওয়ার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। এ জন্যই অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুতেই মতামত দেন। সবাই পত্রিকায় দেন না বা টেলিভিশনের টকশোতে বলতে পারেন না; কিন্তু প্রচুর ব্যক্তি ফেসবুক নামের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়ভাবে এবং খোলামেলাভাবে বলাবলি করেন। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে তার নিজস্ব ব্যাচে প্রথম স্থান অধিকার করে তথা সোর্ড অব অনার পুরস্কার অর্জনকারী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমী গুম বা গায়েব হয়ে যাওয়ার পর থেকে, একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায়, অনেকেই কিছু লেখার আগে বা বলার আগে দুই-তিনবার চিন্তা করে নেন।
কেউ সাতে-পাঁচে আছে, কেউ নেই
সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প থেকে এ ধরনের বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই; কোনো নির্বাচিত প্ল্যাটফরম বা ফোরাম নেই। পত্র-পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত যৎকিঞ্চিৎ ইশারা, ফেসবুকের স্ট্যাটাস ও মন্তব্যগুলো থেকে প্রাপ্ত রিজোনেবল ইশারা এবং বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক মেলামেশার মাধ্যমে প্রাপ্ত রিজোনেবল ইশারার ওপর ভিত্তি করে আমি একটি মন্তব্য করছি নিম্নের কয়েকটি লাইনে। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরও রাজনীতি ও প্রতিরাসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে মতামত গঠনে বা মতামত প্রকাশের প্রোপটে অনেক ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। কিন্তু অন্তত পাঁচটি ক্যাটাগরি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। প্রথম ক্যাটাগরি : ভাস্ট মেজরিটি বা ব্যাপক সংখ্যাধিক্য অংশ হচ্ছেন পিওরলি বাংলাদেশী স্বার্থের অনুরাগী এবং ভারতের নাক গলানোকে অপছন্দ করেন। দ্বিতীয় ক্যাটাগরি : বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের এই সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সমর্থক। তৃতীয় ক্যাটাগরি : রাজপথের বিরোধী দলের শুভাকাক্সী। চতুর্থ ক্যাটাগরি : সাধারণভাবে রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ এবং অতীত এবং বর্তমানের রাজনীতিবিদদের সামরিকবাহিনী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি পছন্দ করেন না; তারা কোনো পে বিশেষ কিছু বলেনও না। পঞ্চম ক্যাটাগরি : বয়োবৃদ্ধ সম্মানিত বড় ভাইরা; শরীর খারাপ অতএব হাসপাতাল-বান্ধব বিভিন্ন বয়সের ব্যক্তিরা; খেলাধুলাবান্ধব অতএব হাতে সময় কম এমন ব্যক্তিরা; হালাল রুজি সংগ্রহের নিমিত্তে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয় চাকরিতে না হয় ব্যবসায় এমন ব্যক্তিরা; ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশকারী ব্যক্তিরা; চিত্তবিনোদন অনুষ্ঠানগুলোতে মনোনিবেশকারী ব্যক্তিরা; অন্যান্য গঠনমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত যথা এতিমখানা চালান, পথশিশুদের যতœ করেন, দরিদ্র নারীদের সেবা করেন, সাহিত্য রচনা করেন; লাস্ট বাট নট দি লিস্টÑ সাতে-পাঁচে থাকার কারণে অতীতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে এমন ব্যক্তিরা; এই পঞ্চম ক্যাটাগরির কাউকেই শ্রদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না; কারণ প্রত্যেকটি কারণই ইতিবাচক এবং অপরিহার্য। যা হোক, এখন আমরা গত সপ্তাহে অসমাপ্ত আলোচনা পুনরায় চালু করছি।
প্রশিক আদান-প্রদান; ভালো না মন্দ
বাংলাদেশের সামরিক প্রশিণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অফিসারেরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশিকের দায়িত্ব নিয়ে (এবং একই কায়দায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর অফিসাররা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রশিণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিকের দায়িত্ব নিয়ে) আসা-যাওয়া করবেন কি না বা মেয়াদ পূর্ণ করবেন কি না, আমি জানি না। কিন্তু লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, এ ধরনের বন্দোবস্ত কোনো না কোনো এমওইউতে থাকতেই পারে। অতএব আমাদের বিবেচনা বা চিন্তার বিষয় হলো, কাজটি ভালো হবে নাকি মন্দ হবে। ভালো-মন্দ শব্দ দু’টি সাধারণভাবে প্রচলিত কথা। এখানে আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের পেশাগত উৎকর্ষতার জন্য এবং আমাদের চিন্তাচেতনা ও তথ্যের নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হবে, নাকি নেতিবাচক? এ প্রসঙ্গে আমার মতামত গত সপ্তাহের লেখায় পরোভাবে তুলে ধরেছি। স্পষ্ট মতামত : ইতিবাচক হবে না, উচিত হবে না। ইংরেজিতে প্রবাদবাক্য আছে ‘ফ্যামিলিয়ারিটি ব্রিডস কনটেমপ্ট’; মানে অতি ঘনিষ্ঠতা অবমূল্যায়ন বা আস্থাহীনতা বা অবমাননার মনোভাব সৃষ্টি করে। সে জন্যই বেশি মাখামাখি ভালো না; পেটে পেটে ভাব বেশি ভালো না। বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক বাহিনীগুলোর যার যার স্থানে নিজ নিজ সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা ভালো।
অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার, ডেইলি সান, নিউ ন্যাশন এই তিনটি নিয়মিত ঘাঁটি; দিনেরটা দিনে না পারলেও অর্থাৎ বিলম্বে হলেও ঘাঁটি। বাংলা দৈনিক প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, মানবজমিন, যুগান্তর প্রভৃতিও নিয়মিত ঘাঁটি। এগুলোসহ বেশির ভাগ পত্রিকায়, এবারের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রসঙ্গে যেসব লেখালেখি হয়েছে, সেসব লেখায় কয়েকটি কথা উঠে এসেছে। একটি কথা উঠে এসেছেÑ প্রধানমন্ত্রী মোদি তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করেছেন; ুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক সম্মানের ব্যাপার; এটা অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। আরেকটি কথা উঠে এসেছেÑ আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতির অফিসিয়াল বাসভবনে রাখা হয়েছে; এটা ুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বিরল সম্মান। দু-একজন আকারে ইঙ্গিতে বলা ছাড়া প্রকাশ্যে কেউই বলেননি যে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী রন্ধনশালার ছোটখাটো একটি টিম নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে মেহমান হয়েছিলেন এবং নিজ হাতে ইলিশ ও আনুষঙ্গিক কিছু রেঁধে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আপ্যায়ন করেছেন। এটা ভারতের রাষ্ট্রপতির জন্য কত বড় সম্মান? কেউ লেখেননি যে, বর্তমান সরকারের অকৃত্রিম বন্ধু মমতা ব্যানার্জি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর রাঁধা ইলিশ খেতে অপারগতা প্রকাশ করেন; এটি উভয়পরে জন্য কত বড় সম্মান? বেশির ভাগ কলাম লেখকই ইনিয়ে-বিনিয়ে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের কথা, বন্ধুত্বের নতুন নতুন উচ্চতার মাপের কথা, বন্ধুত্বের বিভিন্ন আঙ্গিকের কথা লিখেছেন। যারা বেশি ভারতবান্ধব বা বেশি আমাদের সরকারবান্ধব, তাদের জন্য একটু অসুবিধাই হয়েছে বৈকি! কারণ ‘সলিড’ কোনো কিছু নেই লেখার মতো। যে সব চুক্তি বা এমওইউ স্বার হয়েছে, সেগুলো স্বার করার জন্য আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর প থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিল্লি সফরের কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। সাড়ে চার শ’ কোটি ডলারের সার্বিক ঋণ এবং পঞ্চাশ কোটি ডলারের প্রতিরা বিষয়ক ঋণÑ এ দু’টি হলো সবচেয়ে বড় স্বারিত দলিল। এগুলোও আমার ব্যক্তিগত মতে মন্ত্রী পর্যায়ে স্বার করা যেত। এখানে অনেক কলাম লেখক কয়েকটি কঠিন প্রশ্ন তুলেছেন। তার মধ্যে একটি হলোÑ এই চুক্তিগুলো বা এমওইউগুলো স্বারের জন্য বেশি আগ্রহ ও তৎপর কে ছিল; ভারত নাকি বাংলাদেশ? সর্বসম্মত না হলেও, বেশির ভাগের জোরালো অভিমত হলো, ভারতের আগ্রহেই এই চুক্তি ও এমওইউগুলো স্বারিত হয়েছে। পাঁচ-ছয়টি চুক্তি ও এমওইউ নিয়ে আমার এবং আমার মতো শত-সহস্র মানুষের প্রবল আপত্তি রয়েছে। সেগুলো হলো প্রতিরাবিষয়ক পঞ্চাশ কোটি ডলার ঋণের এমওইউ, প্রতিরাবিষয়ক ফ্রেইমওয়ার্ক এমওইউ, ডিফেন্স কলেজ বিষয়ক এমওইউ, স্টাফ কলেজ বিষয়ক এমওইউ এবং রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য একজিম ব্যাংকের ঋণ ও চুক্তি। বেশির ভাগ কলামলেখক ও আলোচক, কী পেয়েছি সেখানে আলোচনার জন্য ‘সলিড’ কিছু না পেয়ে কী পাইনি সেটির ওপরই মনোনিবেশ করেছেন। ভারত থেকে কী পাইনি সেটি যেমন আলোচনায় এসেছে, একতরফাভাবে বাংলাদেশ ভারতকে কী কী দিয়েছে সেটিও বিভিন্ন কলাম লখকের আলোচনায় বিভিন্ন মর্যাদায় ফুটে উঠেছে। কলাম লেখকদের ভাষা ভিন্ন কিন্তু কথা একটাই যথা, আমাদের ত্যাগের কারণে ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় যে উপকার হয়েছে এবং হচ্ছে, ভারতীয় অর্থনীতিতে যে উপকার হয়েছে এবং হচ্ছে তার তুলনায় বাংলাদেশের প্রাপ্তি প্রায় শূন্য। প্রধানমন্ত্রী ও তার গুণগ্রাহীদের ভাষায় আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বন্ধুত্ব। পত্রিকায় প্রকাশিত সব মূল্যবান কলামের রেফারেন্স এখানে উল্লেখ করা বাস্তবসম্মত নয়। তবে পাঁচ-সাত দিন আগে ২০ এপ্রিল ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে ফারুক সোবহানের কলাম বা ইন্টারভিউটি পড়ার জন্য সুপারিশ করছি। ফেসবুকে আমার টাইমলাইনে এবং আমার পেজে সেটি পাওয়া যাবে (২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টার পরের পোস্ট)। ফেসবুকে আমার পেজের শিরোনাম এরূপ : মেজর জেনারেল অব: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক।
ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও কৃতজ্ঞতার বিস্তৃতি
এ বিষয়ের আলোচনার দৈর্ঘ্য দু-চার শ’ পৃষ্ঠার বই হতে পারে; পঞ্চাশ-ষাট পৃষ্ঠা দৈর্ঘ্যরে অধ্যায় হতে পারে কোনো বইয়ে, দশ-বিশ পৃষ্ঠার একটি রচনা হতে পারে; কিন্তু আমি মাত্র দু’টি অনুচ্ছেদে আলোচনা করছি। অনেক কিছু লিপিবদ্ধ করতে না পারার জন্য সম্মানিত পাঠক আমাকে ভুল বুঝবেন না; নিজেরটা নিজে বুঝে নেবেন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের শুরু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯০ লাখ বা প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও যথাসম্ভব খাদ্য ও চিকিৎসা দিয়েছিল ভারত। সব মুক্তিযোদ্ধাকে, অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে ভারত। তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের (নিয়মিত বাহিনী এবং গেরিলা বাহিনী উভয়) রেশন ও পকেট ভাতা দিয়েছে ভারত। প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা সরকারকে এবং আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বাত্মক নৈতিক ও কূটনৈতিক সাহায্য দিয়েছে ভারত। আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সপে কূটনৈতিক জনমত ও সাধারণ জনমত গঠনে সহায়তা করেছে ভারত। চূড়ান্ত পর্যায়ে, সশস্ত্রভাবে ব্যাপকতার সাথে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সামরিক অপারেশন চালিয়েছে ভারত; ভারতীয় সৈনিকেরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ ও রক্ত দিয়েছে। ভারত যদি শরণার্থীদের আশ্রয় না দিত অথবা ভারতের মাটিতে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি করা না যেত অথবা যদি ভারত অস্ত্র গোলাবারুদ রেশন ইত্যাদি দিয়ে আমাদের সাহায্য না করত, তাহলে শুধু বাংলাদেশের ভেতর থেকে শুধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা অবশ্যই অতি কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ হতো; তত দিন বাংলাদেশের নেতৃত্বের ধৈর্য থাকত কি না অথবা তত দিন আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পেতাম কি না, সেটি কঠিন প্রশ্ন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশকে আপাদমস্তক সাহায্যের জন্য, একজন রণাঙ্গনের ুদ্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভারতের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন অতীতে যেমন করেছি, তেমন বর্তমানেও করছি এবং ভবিষ্যতেও করব। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে, ১৯৭১-এর কারণে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ; যদিও ভারতের কারণেই বা ভারতবান্ধব বাংলাদেশীদের কারণেই এই কৃতজ্ঞতার মাত্রা ওপরে নিচে ওঠা-নামা করে। এই মাটির পৃথিবীতে, এই সংসারে সীমাহীন বা অসীম কৃতজ্ঞতা নামক শব্দ কাগজে বা ডিকশনারিতে থাকলেও, সেটি বাস্তবে নেই। বাস্তবে সব কিছুই সীমারেখার মধ্যে থাকতে হবে এবং থাকতে হয়। বেশি টানলে যেমন ইলাস্টিক বা রাবার ছিঁড়ে যায়, বেশি বাতাস দিলে যেমন বেলুন বা গাড়ির টায়ারের ভেতরের টিউব ফেটে যায়, বেশি খাদ্য ভোজন করলে যেমন বদহজম হয়, আনন্দে আত্মহারা হয়ে বৈশাখের বৃষ্টিতে বেশি ভিজলে সর্দি-জ্বর হয়, তেমনি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা দাবি করলে অথবা সীমাহীন কৃতজ্ঞতা দিলে সেটি সমস্যা সৃষ্টি করতে বাধ্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে ভারতেরও কিছু প্রত্য উপকার অবশ্যই হয়েছে। প্রথম উপকার : পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশ ভারত নামক রাষ্ট্রটিকে পশ্চিম এবং পূর্ব দিক থেকে চেপে রাখত; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের পূর্বমুখী ডিফেন্স চেষ্টা বা ডিপ্লয়মেন্ট কমতে কমতে জিরোতে চলে আসে; পূর্বমুখী ডিফেন্সের খরচ কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এখন আছে উত্তর-পূর্বমুখী চীনের বিরুদ্ধে ডিফেন্স বিন্যাস এবং ওই বাবদ খরচ। দ্বিতীয় উপকার : ভারত অর্থনৈতিকভাবে একটি বিশাল বাজার পায় যথা বাংলাদেশীরা ভারতে সফর করেন ও বাজার করেন তথা ডলার খরচ করেন এবং ভারতীয়রা বাংলাদেশে ব্যবসা ও চাকরি করেন এবং নিজ দেশে ডলার ফেরত পাঠান। তৃতীয় উপকার : আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ভারত এক অকৃত্রিম এবং বেশির ভাগ েেত্রই নিঃশর্ত সমর্থনকারী পেয়েছেন, যার নাম বাংলাদেশ। চতুর্থ উপকার : পরাজিত ও আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর অব্যবহিত পরেই ভারত বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশে নিয়ে যায়; সাথে অনেক পরিত্যক্ত শিল্প কারখানার মেশিনারি ও যন্ত্রপাতিও নিয়ে যায়; এসব কিছুর মূল্য শত শত সহস্র কোটি টাকা। পঞ্চম উপকার : বর্তমানে চলছে; বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের বিশাল ভূখণ্ডের সাথে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে ভারতের বিশাল ভূখণ্ডের যোগাযোগকে আশ্চর্যজনকভাবে সংপ্তি ও কম খরচে করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কী পায়নি, তার বিবরণ অনেক দীর্ঘ। সংেেপ বলি। এক. সমমর্যাদাপূর্ণ বন্ধুত্ব পায়নি। দুই. পারস্পরিক চুক্তিগুলো মানার েেত্র দায়িত্ববোধ ও সময়ানুবর্তিতা পায়নি। তিন. ফারাক্কা পয়েন্টে চুক্তি মোতাবেক পানি পায়নি। চার. তিস্তার পানির ভাগ পায়নি এবং পাবে তেমন আশ্বাসও অস্বীকার করা হয়েছে। পাঁচ. অন্যান্য েেত্র চুক্তি না থাকায়, পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। ছয়. বাণিজ্য বাধা দূর হয়নি। সাত. আমাদের সীমান্তের বাইরে ভারতের মাটিতে উৎপাদিত মাদক থেকে বাংলাদেশ রা পায়নি। আট. ভারতের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের আক্রমণ থেকে রা পায়নি। নয়. বিএসএফের গুলি থেকে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা পায়নি। কী পেয়েছি কী পাইনি, তার আলোচনা ওপরের কয়েকটি লাইনে অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তবে বোঝার জন্য অবশ্যই ইঙ্গিতবহ। আমি আমার অনুভূতি ব্যক্ত করছি। ভারত বাংলাদেশের অপরিহার্য প্রতিবেশী; ধনী প্রতিবেশী; শক্তিশালী প্রতিবেশী; চতুর্দিকে চেপে রাখা প্রতিবেশী। ভারত এমন একটি প্রতিবেশী যার চিন্তাচেতনা আকাশপথে, স্থলপথে, পানিপথে, বাণিজ্য মাধ্যমে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে, লেখাপড়ার জগতের মাধ্যমে, চিকিৎসা জগতের মাধ্যমে আমাদের মানুষের মন-মানসিকতার ওপর প্রভাব বিস্তার করেই যাচ্ছে। আমরা চাই আমাদের ওপর ভারতের প্রভাব নিয়ন্ত্রিত হোক। আমরা সম্মানজনক বন্ধুত্ব চাই। আমাদের উন্নতিতে তাদের সহযোগিতা চাই। আমাদের উন্নতিতে অন্য দেশ যেই সহযোগিতা করে, সেখানে তাদের সমর্থন চাই। আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি ধর্ম সাহিত্য সব কিছুর নিরাপত্তা চাই। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছার মূল্যায়ন চাই। আমাদের ত্যাগের মূল্যায়ন চাই। বিনিময়ে, ভারতকে যেমন দিচ্ছি তেমনি দিতে থাকবÑ ০১. আন্তরিক বন্ধুত্ব, ০২. অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং ০৩. নিরাপত্তার সহযোগিতা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের েেত্র বা নিরাপত্তাজনিত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার েেত্র একটি প্রচলিত থিওরি আছে; ওই থিওরিতে বাস্তবে মাটিতে সরেজমিন প্রয়োগ করলে কথাটি এরকম দাঁড়াবে : ভারত যদি নিজের নিরাপত্তা চায় তাহলে ভারতকে বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে; বাংলাদেশ যদি নিজের নিরাপত্তা চায় তাহলে বাংলাদেশকে ভারতের নিরাপত্তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। এই আলোচনা আগামী সপ্তাহে চলবে।
ওপরের আলোচনার প্রোপটে আমাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। কেন প্রতিরা এমওইউগুলো চাপিয়ে দিলেন? কেন পঞ্চাশ কোটি প্রতিরা ঋণ চাপিয়ে দিলেন? কেন তিস্তার পানির জন্য অযথা অজুহাত সৃষ্টি করছেন? এ প্রসঙ্গে আলোচনাগুলো ইনশাআল্লাহ সুস্থতাসাপে,ে পরিস্থিতিসাপেে আগামী সপ্তাহের কলামে সমাপ্ত করব।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : mgsmibrahim@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215101