২৪ জুন ২০২৩, শনিবার, ৮:৫০

আমদানি পণ্যের মজুত কম, দাম বেশি

ডলার সংকট আর আমদানি জটিলতায় দেশের প্রসাধনী বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। গত এক বছর ধরে আমদানিকৃত প্রসাধন সামগ্রীর দাম দফায় দফায় বেড়েছে। এলসি (ঋণপত্র) জটিলতায় চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্য আসছে না। ফলে গত কয়েক মাসে কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর সরবরাহ কমেছে। আর সরবরাহ কমায় মজুতও কমেছে। এতে দামও বেড়েছে কয়েকগুণ পর্যন্ত।
সাধারণত দেশের বাহির থেকে প্রসাধনীর যেসব পণ্য আমদানি হয় তার মধ্যে রয়েছে- কসমেটিক ও টয়লেট্রিজ সামগ্রী, শ্যাম্পু, চিপ্‌স, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার, সাবান, ফেসওয়াশ, ক্রিম, লোশন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও সব ধরনের মেকআপ সামগ্রী। এ ছাড়া সোলার প্যানেল, ফার্মাসিটিক্যাল পণ্য, বাইসাইকেল ও ফ্রোজেন ফুড আমদানি করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা জানান, আমদানি কমায় ব্যালান্স অব পেমেন্টে (চলতি হিসাবে ভারসাম্য) সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যাবে। তবে আমদানি কমিয়ে রাখা মধ্যমেয়াদি কোনো সমাধান নয়।

রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছোট-বড় কসমেটিকসের দোকানে ভিড় নেই। প্রসাধন সামগ্রী পাওয়া গেলেও দাম আকাশছোঁয়া। ব্রান্ড ভেদে সাবানের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত।

দেশি কিংবা বিদেশি সব সাবানেই দর বেড়েছে কম বেশি। বেড়েছে শ্যাম্পুর দামও। আগে যে পণ্যের দর ছিল ৩৫০ টাকা, এখন তা ৫০০ টাকায় ঠেকেছে। এমনকি মিনি প্যাকের দাম বেড়েছে দেড়গুণ। ফেসওয়াশ আগে যা ছিল ২১০ টাকা, তা এখন বেড়ে ৩০০ টাকা। ১৫০ টাকার ফেসওয়াশ কিনতে হচ্ছে ১৮৫ টাকায়। ক্রিম ও লোশনের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আর সব ধরনের মেকআপ সামগ্রীর দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি।

সব পণ্যের দামই আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। বর্তমানে ১৩৫ গ্রামের আমদানিকৃত ডাভ সাবান বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। দুই মাস আগেও এই পণ্যটির দাম ১৫০ টাকা ছিল। ফিআমা ১২৫ গ্রামের সাবান বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা। শ্যাম্পুর মধ্যে সানসিল্ক (৬২৫ এমএল) বোতল ৯৮০ টাকা, ডাভ (৬৮০এমএল) ১২০০ টাকা, টেসলি (৭০০এমএল) ৯৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় ১৫০ টাকার মতো বেড়েছে এসব পণ্যে। ভারতীয় জিলেট রেজার ৪০০ টাকা, জিলেট ফোম ৪৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্যেও ৫০ টাকার মতো দাম বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

ভূঁইয়া জেনারেল স্টোরের এক বিক্রেতা বলেন, এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে এসব পণ্যের দাম। আগে যে লাক্স সাবান বিক্রি করতাম ৩০-৩৫ টাকা তা এখন ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। হুইল বিক্রি করি ৩০ টাকায় কিন্তু আগে দাম ছিল ১৭-১৮ টাকা। ২৮০-২৯০ টাকার শ্যাম্পু ৪০০ টাকা হয়েছে। পেনটিন শ্যাম্পু ৪৯৫ টাকারটা ৬২৫ টাকা হয়েছে। সব পণ্যের দামই বাড়ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়লেও লাভ বাড়েনি। গত কয়েক মাসে ৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে সাবান, তেল, শ্যাম্পু এমনকি স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বিভিন্ন বিদেশি সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশসহ সব ধরনের পণ্যের দামই বেড়েছে। এখনো বেড়েই চলেছে। এতে আগের চেয়ে ব্যবসায়ীদের বেচাকেনাও কমেছে।

কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, এসব প্রসাধন সামগ্রী মানুষের জন্য খুব বেশি জরুরি পণ্য না। তাই দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই এসব পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ আগের চেয়ে কম ব্যবহার করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে কসমেটিকের বাজার ছাড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার উপরে। বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইম্পোটার্স এসোসিয়েশনের মতে, প্রসাধানীর বেশির ভাগ পণ্যের চাহিদা দেশের কোম্পানিগুলো পূরণ করলেও অনেকটা আমদানি নির্ভর এই খাত।

চক বাজারের চুমকি এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মোহাম্মদ আব্দুল করিম জানান, তারা চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া থেকে কসমেটিকস ও মেকাপ আইটেম সরাসরি আমদানি করে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে এখন ডলার সংকট আর আমদানি জটিলতায় আগের আনা মজুত পণ্য কমেছে। ফলে দাম বাড়িয়েও সংকট সমাধান করা যাচ্ছে না।

বিক্রেতারা জানান, নামি-দামি দেশীয় ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য নকল করে ডিলারদের মাধ্যমে সারা দেশের বিভিন্ন প্রসাধনীর দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী জেনে ও অনেকে না জেনেও ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। এ ছাড়া বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল পণ্য দেশে তৈরি করে বিদেশি বলে বিক্রি করা হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মানহীন, অনুমোদনহীন ফেস ক্রিম ও ত্বক ফরসাকারী ক্রিম।

নাজমা খাতুন বলেন, ত্বক ফর্সা হওয়ার ক্রিম কিনে এক সপ্তাহ পরে যথেষ্ট ফর্সা হয়েছিল। কিন্তু ১৫ দিন পর থেকেই মুখে ব্রন ওঠা শুরু করে। পরে বুঝতে পেরেছি মানহীন পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া উকুন মারার শ্যাম্পু যথাযথ নিয়মে ব্যবহার করেও ফলাফল শূন্য।
সম্প্রতি রাজধানীর কাওরান বাজারে টিসিবি ভবনে ভোক্তা অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে কসমেটিকস পণ্য আমদানিকারক ও বাজারজাতকারীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, দেশের বিভিন্ন বাজার নকল ও ভেজাল কসমেটিকে ভরে গেছে। সারা দেশে এ ধরনের নকল ও ভেজাল প্রতিরোধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হবে। অভিযানে কোনো ব্যবসায়ী বাধা দিলে সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটির বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে কসমেটিক আমদানির নামে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। ইনভয়েস জালিয়াতির মাধ্যমে বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে ভারত থেকে কসমেটিকস পণ্য আমদানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্রমতে, কসমেটিকস পণ্য আমদানিতে বিশেষ করে ক্রিম আমদানিতে মোট শুল্ককর ১৫৭.৩০ শতাংশ, ফেসওয়াশ, সাবানের মোট শুল্ক কর ১২৭.৭২ শতাংশ, শ্যাম্পু, হেয়ার কালার ১৮৩.৪০ শতাংশ, বডি স্প্রে, শেভিং ক্রিম ১৩১.২০ শতাংশ। কসমেটিকস পণ্য আমদানিতে শুল্ক কর বেশি হওয়ায় কিছু আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট যোগসাজশ করে শুল্ক কর ফাঁকি দিয়ে আসছে। এতে কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সহযোগিতা করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চীন থেকে রাইস কুকার, প্রেশার কুকারসহ ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানি করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন ফিরোজ আহমেদ। তার প্রতিষ্ঠান অনয় হার্ডওয়্যার ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ডলার সংকটের কথা বলে কোনো ব্যাংক এলসি খুলতে রাজি হয় না। গত দুই মাসে ২০টি ব্যাংকে ঘুরেও এলসি খুলতে পারিনি। এখন হাত গুটিয়ে বসে আছি। কর্মচারী ছাঁটাই করে দিয়েছি।

আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমদানি একটি চেইন ব্যবসা। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তাছাড়া ডলারের দামও এখন বেশি। রাইস কুকার, রুম হিটার, অন্যান্য কুকারসহ গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এখন নিত্যপ্রয়োজনীয়। আমদানি বন্ধ থাকায় গত কয়েক মাস পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে পড়েছে।

এদিকে মজুতও কমে আসছে। সেজন্য এসব পণ্যের দাম অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা প্রসাধনী পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ আমদানি শুল্ক (শুল্ক কর) আরোপের প্রস্তাব করেছে সরকার। ইতিমধ্যেই এর প্রভাবও পড়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম আরও বেড়ে গেছে।

মেডিকেল ডিভাইস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস এম সার্জিক্যালের স্বত্বাধিকারী খোকন আলী বলেন, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে কোনো ব্যাংকই এলসি খুলতে রাজি হয়নি। জানুয়ারির শুরুতে কয়েকটি ব্যাংক এলসি খুললেও এসব পণ্য আসবে আরও ৪০-৪৫ দিন পর। যার কারণে ব্লাড ব্যাগ, ক্যাথেটারসহ প্রতিটি পণ্যের সংকট রয়েছে। দোকানেও বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে।

কঞ্জুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাবের) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, সমস্যা অনেক রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও দাম বাড়ে, সে পণ্য এখানে আসুক বা না আসুক। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে সেই অনুপাতে দাম কমে না।

ওদিকে সোলার প্যানেল আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তাই আমদানি ব্যাহত হওয়ায় সোলার প্যানেলের সংকট দেখা দিয়েছে। দামও বেড়ে গেছে।

সোলার বাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার রোমান হোসেন জানান, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। সেজন্য আমদানিও করা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে সোলার প্যানেলের চাহিদা অনেক বেড়েছে। ফলে বাজারে এর সংকট চলছে। কমে আসছে মজুত। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সোলার দেয়া যাচ্ছে না। দামও অনেক বেড়ে গেছে। সে কারণে ব্যবসায়ীরাও সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তাই দ্রুত সমস্যা সমাধান চান ব্যবসায়ীরা।

উল্লেখ্য, ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয়ের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ডলারের দাম গত ১ বছরে টাকার বিপরীতে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ডলারের ঘাটতির কারণে ফল আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে ২০২২ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে নিয়ন্ত্রক শুল্ক আরোপ করে। পরবর্তীতে ফল আমদানিতে ঋণ সুবিধাও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের ২৪শে মে এনবিআর অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের সঙ্গে সব ধরনের ফল আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে নিয়ন্ত্রক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করে।

https://mzamin.com/news.php?news=61852