২৩ জুন ২০২৩, শুক্রবার, ৯:৩৮

শ্বেতহস্তী হওয়ার শঙ্কা জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত

-সঙ্কট হলো গ্যাসের, যা মানুষের সৃষ্টি : বিশ্লেষকের অভিমত

তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির ওপর আরো নির্ভরতা বাড়িয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত শ্বেতহস্তীতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সরকার মোটেই বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঙ্কট হলো গ্যাসের। জ্বালানি সঙ্কট মানুষের সৃষ্টি। আর এটা এলএনজি আমদানির জন্য। রাতারাতি আইন বদলে গেল। দাম বাড়াতে বিপিসিকে আর বিইআরসিতে আসা লাগল না। বিপিসি নিজেই ব্যবসায়ী। রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে গতকাল ‘জ্বালানি ও বিদ্যুৎবিষয়ক সমস্যা এবং প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এমন আশঙ্কার কথা জানানো হয়।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ-সংক্রান্ত গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। আলোচনায় অংশ নেন- এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খসরু মো: সেলিম প্রমুখ।

ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ খাত ভর্তুকিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ভর্তুকির হার গত বছরের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। জিডিপি হিসাবেও অনেক বড়। ভবিষ্যতে এমন ভর্তুকির বিষয়টি কিভাবে হ্যান্ডেল করা হবে? এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন। তিনি বলেন, এক দিকে লোকসান, অন্য দিকে ফিক্সড অ্যাসেটে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়ার পাশাপাশি লোকসানের অজুহাতে জনগণের কাছ থেকে ট্যারিফ মূল্য বাড়িয়ে বাড়তি অর্থ আদায় করা হচ্ছে। আমার কাছে এ হিসাবটা গোলমেলে মনে হচ্ছে।

তিনি জানান, বিপিসি, বিপিডিপি ও পেট্রোবাংলাসহ এনার্জি সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিংয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এখানে স্বচ্ছতার প্রয়োজন। সর্বশেষ জ্বালানির মূল্য বাড়ানোর ফলে বিপিসি বিপুল পরিমাণ লাভ করে যাচ্ছে। বাজারভিত্তিক মূল্যব্যবস্থায় যদি সরকার যায়, তাহলে ভোক্তার ওপর বোঝা বাড়তেই থাকবে। ক্যাপাসিটি কস্ট যদি বাদ বা কমানো যায় এবং স্বচ্ছতা বাড়ানো যায়, তাহলে ভোক্তাপর্যায়ে মূল্য কমানো সম্ভব।

উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ২৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি বরাদ্দের ৯৩ শতাংশ রাখা হয়েছে পাওয়ার জেনারেশনে। বাজেটে ৯৬টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র পাঁচটি দেখতে পাচ্ছি নবায়নযোগ্য জ্বালানি। আগামীতে ২৩ হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ যোগ হতে যাচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রী বলেছেন। বাড়তি এ বিদ্যুৎ নিয়ে কী করব, সেটিই দুশ্চিন্তার কারণ। তিনি বলেন, গত এক বছরে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। সর্বোচ্চ ২৫০০ মেগাওয়াট ও সম্প্রতি প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরেও বিদ্যুৎ থাকছে না।

তিনি বলেন, প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি ক্যাপাসিটি রয়েছে। বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি পেমেন্টের ধকলে, এটা বহন করা (আনবিয়ারেবল) কষ্টসাধ্য অবস্থায় চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) তার ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা নিচ্ছে। টোটাল সাবসিডির ২৭ শতাংশ ভর্তুকি সাবসিডি দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে। যার মূলে রয়েছে এই ক্যাপাসিটি চার্জ। অন্যান্য সামাজিক খাতে অর্থ দিতে পারছি না।

সিপিডির মতে, সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে মোটেই বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে যে উদ্যোগ ও পরিকল্পনা করা দরকার তা হচ্ছে না। বিদ্যুৎ খাতে এলএনজির ওপরে আরো নির্ভরতার কৌশল আমরা দেখতে পাচ্ছি। অথচ এ জায়গা থেকে সরে আসা দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে এখনো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। যে পথে সরকার যাচ্ছে, সেটি শুভকর নয়। লোডশেডিং চলমান থাকবে। জ্বালানি সেক্টরের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ আগামীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর বর্তমানে আইএমএফকেন্দ্রিক যে সংস্কার চলছে, সেই সংস্কার দিয়ে জ্বালানি খাতের সংস্কার সম্ভব হবে না। এর বাইরে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখতে হবে মনে করে সিপিডি।

অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) এখন আর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) যাওয়া লাগছে না। আইন পরিবর্তন করে বিপিসিকে ব্যবসায়ী বানানো হয়েছে। তিনি বলেন, রাতারাতি আইন বদলে গেল। দাম বাড়াতে বিপিসিকে আর বিইআরসিতে আসা লাগল না। বিপিসি নিজেই ব্যবসায়ী, নিজেই ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণ করে। অর্থাৎ ব্যবসায়ী নিজেই তার পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। তিনি বলেন, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, মনোপলি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। যা দাম নির্ধারণ করেছে, সে দামে আমাদের কিনতে হবে। এত বড় অবিচার কোথাও আছে জানা নেই। আইন পরিবর্তন করে গণশুনানি তুলে দেয়া হলে যাতে আমরা বলতে না পারি কত হাজার কোটি টাকা কোথায় চুরি হয়েছে। কোথায় লুটপাট হয়েছে, কিভাবে হয়েছে তা জানতে যেন না পারি সে কারণে।

তিনি বলেন, ২০২২ সালে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় দেখা গেল জ্বালানি উন্নয়ন ফান্ডের ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয়নি। ৩৫ শতাংশ জ্বালানি কোথায় কিভাবে ব্যয় করেছে সেটি কেউ বলতে পারছে না। শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলে টাকা দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো না দিলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমতো। আমাদের টাকার ওপর সুদ নেয়া হচ্ছে। এভাবে আমরা ঠকছি। তিনি বলেন, ট্রান্সমিশন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কাছে ১৪ হাজার কোটি টাকা জমা আছে। তার আগে আইন করে বিদ্যুৎ খাত, জ্বালানি খাত হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। আমরা ফান্ড স্ট্যাবলাইজ ফান্ড করার কথা বলেছি; কিন্তু সেসব কথা শোনেনি। এখন ৮ ঘণ্টা, ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, কয়লা ও জ্বালানি আনতে এখন বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। সতর্ক না হলে আগামীতে এই ব্যয় দ্বিগুণে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেসব গ্যাসকূপ আছে তা বিদেশীদের কূপের চেয়ে অনেক কম উৎপাদন ক্ষমতার। জরিপ করে সমস্যা চিহ্নিত করা হলো। সুপারিশ দেয়া হলো। কিন্তু সেই সুপারিশ কোনো কাজেই লাগানো বা বাস্তবায়ন করা হলো না। তিনি বলেন, সঙ্কট বিশেষ করে গ্যাসের। তা আমাদের মানুষের সৃষ্টি। আর এটা এলএনজি আমদানির জন্য করা। এই সমস্যা অনেক গভীরে। সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকতেও আমরা তা ইনটেনশনালি এড়িয়ে যাচ্ছি।

অধ্যাপক খসরু মো: সেলিম বলেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিস্থিতি হতাশাজনক। আমরা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাচ্ছি না।
ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের সমস্যা হলো জ্বালানিতে। আমরা প্রাক্কলন করি মেগাওয়াট ভিত্তিতে, যা ভুল। তিনি বলেন, সরকার প্রতি বছর দেশে ২৫টি নতুন কূপ অনুসন্ধান করতে পারে; কিন্তু তারা তাতে নয়, জ্বালানি আমদানিতে আগ্রহী। দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং। কেন এটা হবে। আমাদের তো সোলার সুবিধা করতে পারি; কিন্তু সরকারের এ দিকে নজর নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/757544