২৬ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ৮:১৩

তুরস্কের গণভোটে সবাই বিজয়ী

|| হারুন ইয়াহিয়া ||

সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য তুর্কি জাতি গত ১৬ এপ্রিল আবার গণভোটে অংশ নিলো। ভোট পড়েছে উচ্চ হারে এবং ওই নির্বাচনের দিনে দেশজুড়ে বিরাজ করছিল প্রশান্তি। এই নির্বাচন তুর্কি জাতির গণতান্ত্রিক অভিমত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানান দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারাভিযান থেকে শুরু করে গোটা পৃথিবী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার অনেকেই এই গণভোটকে এমনভাবে মূল্যায়ন করেছে যে, যেন দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে, যদিও এই উদ্বেগ ছিল ভিত্তিহীন।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান কেন নন স্বৈরশাসক
২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ক্ষমতায় আসেন। তুর্কি জাতি এরও আগে থেকে এমনকি যখন তিনি ছিলেন ইস্তাম্বুলের মেয়র, তখন থেকে এরদোগানের সেবাকর্ম দেখে আসছে। তিনি তুরস্কের অনেক মহাসড়ক, সেতু ও উপসড়ক নির্মাণের পেছনে ছিলেন। এসব নির্মাণের ফলে তুরস্কে পরিবহনের ক্ষেত্রে উন্নততর সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর পরও তার স্থানীয় প্রতিপক্ষ ও পাশ্চাত্যের অনেকেই তাকে অভিযুক্ত করে আসছিল ‘ওয়ান ম্যান’ হিসেবে। তবে আমাদের ভুললে চলবে না, এটিই যুক্তিযুক্ত যে পরস্পরবিধ্বংসী ২০ জন থাকার চেয়ে একজন জ্ঞানী থাকাই উত্তম। জাতি বিভিন্ন ঘটনায় প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে পরীক্ষা করেছে বহু বছর ধরে। তারা দেখেছে, তিনি কোনো ভুল করেননি, বরং নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তার দেশের জন্য এবং দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্পদ ও উপকার। তার ক্ষমতায় থাকার সময়ে পরিবহনের নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি তিনি শুধু নগরগুলো সৌন্দর্য বাড়িয়েই তোলেননি, একই সাথে রাস্তার পাশ সুশোভিত করেছেন গাছ ও ফুলে ফলে। নগরগুলোকে পাল্টে দিয়েছেন আধুনিক শৈল্পিক প্রযুক্তির সংযোজন ঘটিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেÑ তিনি আইএমএফের সব ঋণ পরিশোধ করে দেশকে আইএমএফের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করেছেন। অর্থনীতিকে করেছেন স্থিতিশীল। যদিও তার ওপর ছিল দেশের ভেতর ও বাইরের চাপ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটি এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয় যে, একে পার্টির নীতি দেশটির জনগণকে শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি এও প্রমাণ করেছেন, তিনি লেগে আছেন তার সেবাকর্মে অনেক ঝুটঝামেলার মাঝেও। সব সময় তিনি তা উতরে গেছেন।
কেন আমি বলি ‘হ্যাঁ’
আমি সংবিধানের পরিবর্তন করা অনুচ্ছেদগুলো বিশদভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছি। এগুলোর মূল্যায়ন করেছি গভীরভাবে। কথা বলেছি সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সাথে। যারা ‘না’ বলেছেন, তাদের রয়েছে নিজস্ব অভিমত। কিন্তু এটা দেখা কঠিন নয় যে, তুরস্ক এগিয়ে যায় অনেক জটিল স্তর অতিক্রম করে। এটি বেরিয়ে আসছে অভূতপূর্ব রক্তাক্ত অভ্যুত্থানপ্রয়াসের অবস্থা থেকে। ঠাণ্ডা মাথায় ট্যাংক চালিয়ে দেয়া হয়েছিল বেসামরিক লোকদের ওপর। আমরা হারিয়েছি অনেক শহীদ ও বীরকে। অধিকন্তু সরকার যুদ্ধ চালিয়ে আসছে তুরস্কের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের পিকেকের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। তা ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়ে আছে দ্বন্দ্ব। যেমন সিরিয়া; দেশটির সাথে তুরস্ক জড়িত ক্রসবর্ডার অপারেশনে। একই কথা খাটে ইরাক নিয়ে, সেখানে বিশ্ববাসী দেখছে নিত্যদিনের বোমাবাজি ও সামরিক অভিযান। যার ফলে ঘটছে ব্যাপক লোকক্ষয়। উল্লেখ করা বাহুল্য, ইউক্রেন ও রাশিয়ায় চলছে থেমে থেমে সংঘর্ষ। অতএব এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট, এ এলাকায় স্থিতিশীল এক তুরস্ক প্রয়োজন, যেখানে তুরস্ক রয়েছে দেশী-বিদেশী চাপের মুখে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে নৈতিক বিপর্যয়কে ‘না’ বলতে। এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে কঠোর অবস্থান নেয়া সঠিক নয়। জনগণের তাই চাওয়া উচিত যা তুরস্ক ও তুরস্ক জাতির জন্য সঠিক।
আমাদের রেডলাইন ফেডারেশন সিস্টেম
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিয়ে এসেছেন অন্য ধরনের প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম, যা আমি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করি। এর কারণ এগুলো সবই ছিল একটি ফেডারেটিভ সিস্টেমের জন্য উন্মুক্ত, যাতে থাকবে ছোট ছোট ফেডারেল স্টেট। আর তা শেষ পর্যন্ত তুরস্ককে ভেঙে খান খান করে দেবে। আল্লাহ আমাদের তা থেকে দূরে রাখুন। একেপি প্রথমে সামনে নিয়ে আসে আমেরিকান মডেলের একটি প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা, এরপর আনা হয় মেক্সিকান মডেল এবং আরো অনেক মডেল। আমি এসবের প্রতিটি প্রত্যাখ্যান করি। কারণ ফেডারিটিভ সিস্টেম আমাদের জাতির জন্য রেডলাইন। এরপর এরা নিয়ে এলো এমন একটি সিস্টেম, যার নাম অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্সি। এ সিস্টেমে নিশ্চিত করা হয় আমাদের দেশের ইউনিটারি কাঠামো। এমএইচপি নেতা ডেভলেট বেহবেলি এ নতুন সিস্টেম সমর্থন করলে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তিনি একজন সৎ রাজনৈতিক নেতা এবং তুরস্কের ঐক্যবদ্ধতা রক্ষায় খুবই সতর্ক। তিনি কখনোই এমন কিছু সমর্থন করেননি, যা তুরস্কের সংহতি বিনষ্ট করতে পারে এবং তিনি বরাবর সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকের বিরুদ্ধে।
গণভোটের পর তুরস্কের কী হবে
আমি তুরস্কের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী এবং আমি বিশ্বাস করি, বাইরের দুনিয়ার চাপ, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের মাঝেও তুরস্ক এগিয়ে যাবে। গোটা ইসলামি দুনিয়ার জন্য তুরস্ক হবে একটি আধ্যাত্মিক নেতা ও রোলমডেল। তুরস্কের নেতৃত্বে ইসলামি দেশগুলো ইসলামি বোঝাপড়াকে আলিঙ্গন করবে। যেখানে নারীদের যথাযথ মর্যাদা থাকবে এবং একই সাথে জীবনের সব ক্ষেত্রে থাকবে উঁচুমান, বিজ্ঞান, নান্দনিকতা ও সৌন্দর্য। তুরস্কে আমাদের জনগণ অনুশীলন করছে শান্তিপূর্ণ ইসলাম, যার ভিত্তি ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও পরার্থবাদ। এখানে নেই কোনো সন্ত্রাস ও ঘৃণা। আমি অব্যাহতভাবে বিরোধিতা করে যাবো এমন কোনো মডেলের, যেখানে কুরআনের অস্তিত্ব নেই।
আমি অভিবাদন জানাই আমার জাতিকে, যারা আবার গণতন্ত্রের পরীক্ষায় উতরে হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য রোলমডেল। এই গণভোটে কোনো পরাজিত পক্ষ নেই; এখানে যে যে পক্ষেই ভোট দিন না কেন গোটা জাতি বিজয়ী হয়েছেÑ যেমনটি নির্বাচনোত্তর সময়ে বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, ‘উই আর অল ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স ইন এ সিঙ্গল বডি.... থ্যাংক ইউ তার্কি, থ্যাংক ইউ মাই হলি ন্যাশন.... দ্য ন্যাশন সেইড দ্য লাস্ট ওয়ার্ড, অ্যান্ড সেইড ‘ইয়েস’।
লেখাটি : আরব টাইম থেকে নেয়া ইংরেজি সংস্করণের ভাষান্তরিত বাংলা সংস্করণ
ভাষান্তর : গোলাপ মুনীর

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215098