২৩ জুন ২০২৩, শুক্রবার, ৯:১৪

একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের গাড়ি কতদূর

জাকির আবু জাফর

শাক দিয়ে মাছ যে ঢাকা যায় না এটি সবার জানা। তবে শাকের পরিমাণ যদি খুব বেশি হয়, মাছটি ঢাকা পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু আমাদের নির্বাচন নামক মাছটিকে কোনোভাবে কথার শাক দিয়ে আর ঢাকা যাচ্ছে না! যদিও কথার শাক বিপুল! ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনী মাছটির শরীর এমনই চর্বিযুক্ত মোটা তাজা থলথলে, একে ঢাকার মতো কৌশলী-শাক আর সাধ্যে নেই।

তবু ঢাকার চেষ্টা বড় জোরালো। কেন এমন জোরালো! চাইলেই কি ঢেকে রাখা যায়! নাকি ঢেকে রাখা সম্ভব! নাকি ঢেকে রাখা উচিত!

অবশ্য ‘উচিত’ শব্দটি এখন বলা উচিত নয়! মানানসইও নয়! ‘ন্যায়’ শব্দটিও খুব বেমানান! ‘ইনসাফ’ শব্দটিরও পাত্তা নেই কোথাও। ‘সততার’ কথা ভুলতে বসেছে মানুষ! বিষয়টি এমনই যে, মানুষ আবার সৎ হয় কিভাবে! সততা বোকাদের গুণ! চালাক মানুষ সৎ হয় কী করে! ‘লোকটি সৎ, কেননা ঘুষ নিয়ে কাজটি করে দিয়েছে’- এ তো এখন সততার মাপকাঠি। এর সাদা অর্থ দাঁড়ায়- ঘুষ নিয়েও কাজ করে দেয় না অনেকে।

আর ‘দায়িত্ব’ বেচারার বড়ই বেহাল দশা। দায়িত্ব এখন দায়িত্ব হারিয়ে এতিম। ‘মানবতা’ এখন নির্বাসিত। কোন বনে নির্বাসন জানা নেই তাও! ‘ন্যায়বিচার’ কথাটি বড় অদ্ভুত শোনায়! ভাবসাব হলো- বিচার তো বিচার। এর আবার ন্যায় অন্যায় কী! যার শক্তি আছে তাকে ফলটি পেড়ে দেয়াই তো বিচার। ক্ষমতা যার তাকে সুরক্ষা দেয়াই বিচারের কাজ! অপরাধীকে নিষ্পাপ ঘোষণার আয়োজনই এখন নিয়ম।
তাহলে কী নিয়ে গর্ব করি আমরা। কী নিয়ে করব। ‘বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি’ কথাটি কতটা সত্য! কতটা যৌক্তিক! সত্যি কি মাথা উঁচু আমাদের! নাকি এতটাই নিচু যে মুখ দেখানোরও জো নেই। উন্নত সমাজের দিকে চোখ তোলার সাহস কি আছে আমাদের!

বুঝতে হবে জাতি হিসেবে আমাদের অমর্যাদা কোথায়! কেন আমাদের জন্য অন্যদের চোখ টাটানি! কেন আমরা অবিশ্বস্ত! বিশ্ব কেন আমাদের বাঁকা নয় শুধু, ভয়ের চোখে দেখে! আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথায় আস্থা নেই কারো! উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের চোখে অনেকটা ছি ছি ভাব! কেন? কী অপরাধ আমাদের। গরিব দেশ বলে! গরিব হলে কি অবজ্ঞার! নাকি অন্য কারণ আমাদের সৌন্দর্য শুষে নিচ্ছে! হ্যাঁ, চোখ বন্ধ করে দেয়া যায় এর জবাব। আমরা আমাদের নামিয়েছি অপমানের তলানিতে। আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের একেকটি চেহারা দেখুন! ক’টি চেহারা ঘুষের দাগ মুক্ত! ক’টি মুখ সততার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল! ক’টি চোখ অবৈধ সম্পদ লোভের চকচকানি মুছতে পেরেছে! ব্যাংক লুটেরাদের চেহারা চেনে না কেউ! অর্থ পাচারকারীরা কি এ সমাজের নয়! অবৈধ সম্পদের মালিকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে না এখানে! বেগমপাড়ার ধ্বজাধারী কারা জানে না কেউ!

এখানে ভোটের অধিকার নেই এটি কে অস্বীকার করবে! একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কেন এত কঠিন হয়ে উঠল! কেন একটি নির্বাচন ঘিরে এত ডামাডোল! অথচ রাজনীতির মাঠে নির্বাচন তো একটি সহজ খেলা। এ খেলার খেলোয়াড় সব রাজনীতিক। সব রাজনৈতিক দল। এমনকি সব যোগ্য নাগরিকও বটে। তাই কে কাকে বাদ দিয়ে খেলবে এখানে। কেন খেলবে! এটি তো একাকী কিংবা এক-দু’টি দলের খেলা নয়। কে কাকে বলবে- তুমি এসো না! কিংবা এলে আসো, না এলে কিছু করার নেই! এটিও কি বলা যায়!

এ খেলার রেফারি নির্বাচন কমিশন! আর কে না জানে- রেফারির কাজ খেলার নিয়মের ওপর দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা। খেলে জিততে হবে খেলোয়াড়দের- গায়ের জোরে কিংবা বাহুর জোরে নয়। এটি নিশ্চিত করা নির্বাচন-রেফারির কাজ। এ কাজে আমাদের নির্বাচন রেফারি যে ব্যর্থ- এ কথা আর বলার দরকার নেই।

নির্বাচনী খেলায় জয় পেলেই শুধু পাওয়া যায় ক্ষমতার মসনদের টিকিট। নির্বাচন ক্ষমতার ‘ইয়েস কার্ড’। এ কার্ডের মালিক জনগণ। জনগণের এই অনুমতিপত্র না নিয়ে শাসন করার ইচ্ছেটি বৈধ বলার অবকাশ আছে কি! নেই তো। যদি না থাকে তবে কেন একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতার লালসায় মাততে হবে। কেন চেপে বসতে হবে জনতার ঘাড়ে। নাগরিক হিসেবে এ প্রশ্ন কি অবান্তর।

এ জাতির নাকে অপমানের রশি বেঁধে টেনে নেয়ার মানসিকতা কেন জন্মাল রাজনীতিকদের! কেন যেনতেন করে কেবল ক্ষমতার রশি হাতাতে হবে! ক্ষমতা কি জনগণের আমানত নয়! ক্ষমতার মসনদের সাথে পবিত্র শব্দটির যোগ নেই কি! নেই কি সততার সংযোগ! যদি থাকে, কেন মানবে না! আর যদি না থাকে এর জন্য দায়ী কে, কারা! এর পেছনে লুকায়িত অন্ধকার কি! যা বলার আমরা তা কি বলছি! যা করার তা কি করছি!

আসুন তবে শেকড়ের দিকে ফিরি! অবশ্য শেকড়ের কথা বললে মুখ কালো হয়ে ওঠে অনেকের। কেন? কারণ শেকড়ে ফেরা মানে ঐতিহ্যের দিকে ফেরা। আর ঐতিহ্য কখনো মানুষকে মানবিক আচরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে না! মানবিক আচরণ যার উত্তম, সে কখনো জুলুম করে না। করতে পারে না। সে হতে পারে না জালিম। হতে পারে না স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী।

আমাদের জাতি কি সৎ? আমরা কি সত্য বলি! অবৈধ অর্জনকে আমরা ঘৃণা করি কি! অন্যের সম্পদ লুট করার লোভে আমরা নির্লজ্জ হই? মজুতদারির মতো অনৈতিক কর্মে পারদর্শিতা নেই কি এ জাতির? ন্যায়বিচার তো বিলকুল নির্বাসিত! আমাদের আইনের হাত শক্তিমানদের ছুঁতে পারে কি! যদি না পারে তো এ রশি কার গলায় ফাঁস হয়ে ওঠে! শক্তিহীনদের গলায় নয় কি!

একে রাজনীতিইবা কেন বলব! রাজনীতি মানে নীতির রাজা। কিন্তু এ দেশে রাজনীতির নামে ব্যক্তিনীতি, স্বার্থনীতি কি চলছে না! এখানে রাজনীতি প্রতিহিংসার প্রকাশ নয় কি! প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করার আয়োজন প্রবল নয় কি! দাম্ভিকতার চূড়ান্ত রূপ কি প্রকাশ্য নয়! তাই ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো অপমানের রশি ঝুলে আছে জাতির ঘাড়ে! এর জন্য কে দায়ী? এ জিজ্ঞাসা কি অবান্তর! নাকি অযৌক্তিক! নাগরিক হিসেবে আমাদের আত্মসম্মানে বড় ঘা লাগে। জাতি হিসেবে নিজেদের ক্ষুদ্র মনে হয় খুব।

জনমত তোয়াক্কা না করা শাসকদের আদর্শ- ম্যাকিয়াভেলি। দ্য প্রিন্স বইটিতে ম্যাকিয়াভেলি লিখেছেন ‘শাসনক্ষমতার বৈধতা কোনো নৈতিকতার মাপকাঠিতে আবদ্ধ নয়; কর্তৃত্ব আর ক্ষমতা এখানে মূল বিষয়। যার ক্ষমতা আছে সে-ই শাসন করবে, নৈতিকতা কাউকে ক্ষমতায় বসায় না। ক্ষমতা অর্জন আর ক্ষমতা রক্ষা করা রাজনীতির মূলনীতি।’

আধুনিক সভ্যতা এ মনোভাব প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি ঘৃণাও করে। আধুনিক সভ্যতা মানুষকে মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শিখিয়েছে। সে কারণে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র আদৃত। আধুনিক বিশ্বে এটি প্রমাণিত যে, গণতন্ত্রের বিকল্প কেবল গণতন্ত্র। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় এর চেয়ে কার্যকর কোনো পদ্ধতি আপাতত জানে না বিশ্ব। হ্যাঁ, এরও দুর্বল দিক আছে। থাকবেও। তা সত্ত্বেও গণতন্ত্র এখন পর্যন্ত জনপ্রিয় নেতা নির্বাচনে কার্যকর। যোগ্য শাসক নির্বাচনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি।

সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন গণতন্ত্র রক্ষার প্রধানতম মাধ্যম। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের ভালো ফল পাওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে এখন এ সময় ডজন ডজন সমস্যার পাহাড়চূড়া মাথা উঁচু করে আছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র। বাণিজ্যিক অব্যবস্থাপনা প্রকট। বিদ্যুতের লোডশেডিং। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জটিল সমস্যায় জর্জরিত দেশ। রাজনৈতিক সমস্যার ইতি নেই। এসব সমস্যা এখন একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানের খিল খোলা অসম্ভব! জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে- রক্তে কেনা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কি সোনার হরিণ! কতদূর তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের গাড়ি!
লেখক : কবি, কথাশিল্পী ও গীতিকার

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/757471