২০ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৫২

তদারকির অভাবে বাস্তবায়ন হয়নি

বাংলাদেশে গত ১৩ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের আকার প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা থাকলেও এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে এই পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। কারণ সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণকেও তারা খেলাপি দেখানোর পক্ষে। বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতেই খেলাপি ঋণের প্রায় পৌনে এক লাখ মামলা ঝুলে রয়েছে, যাতে এক লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। আর খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিন থেকে দেশের ব্যাংকিং খাত তথা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এমনকি এই ঋণকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীরব ঘাতকও বলা হয়ে থাকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে এই নীরব ঘাতক দূরীকরণে নজর দেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে বিশেষ সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইচ্ছাকৃত নয়, নানাবিধ কারণে মন্দ ও ক্ষতি জনিত মানে শ্রেণিকৃত খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং ব্যবসা থমকে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার সচল করার উদ্যোগ নেন। চিন্তা ছিল নগদ অর্থ ব্যাংকে আসবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে, বন্ধ কলকারখানার চাকা সচল হবে এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। এ জন্য ২০১৯ সালের মে মাসে জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়, ঋণ খেলাপিরা ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত স্থিতির ওপর মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট প্রদান করে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। পরবর্তীতে নানা কারণে এই সময় বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। খেলাপি ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত সঠিক তদারকির অভাবে প্রায় ৫ বছরেও সামনে আগায়নি। এমনকি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের উদ্যোগও চোখে পড়েনি। এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সবাই সভা-সেমিনারে ব্যস্ত বলে জানিয়েছেন। অথচ এই সুবিধা নেয়ার জন্য যারা অবেদন করেছেন অধিকাংশেরই দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ধার-দেনা করে ঋণ খেলাপির তকমা থেকে বের হওয়ার জন্য এই সুবিধার আওতায় অবেদন করেছিলেন। কিন্তু অবেদনের পরপরই মাহমারি করোনার বিপর্যস্ততার মধ্যে পড়া এবং পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মন্দাবস্থার মধ্যে পড়েন গ্রাহকরা। আর এ সময় তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা না পেয়ে বরং অনেককে বিপাকে পড়তে হয়েছে। আবার ভিন্নতাও রয়েছে তাদের ঘনিষ্টজনেরা পেয়েছেন বাড়তি সুবিধা। যে কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি এক অর্থে ভেস্তে গেছে। এছাড়া বর্তমান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার অর্থ সচিব থাকাকালীন করোনার সময়ে লাখো কোটি টাকার বেশি বিশেষ প্রণোদনাও দিয়েছেন। এমনকি ২০২০ সালে কাউকে খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, ১৫ শতাংশ দিলেই তাকে খেলাপিমুক্ত রাখা হয়েছে। ২০২২ সালেও যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপি হবেন না এ সুবিধা দেয়া হয়। এমনকি প্রণোদনা সুবিধা যারা নিয়েছেন তারা এখন পর্যন্ত ব্যাংককে কোনো টাকাই ফেরত দেননি। এমনকি প্রণোদনার টাকা দিতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে ভুগছে ব্যাংকগুলো। কবে নাগাদ প্রণোদনার এই টাকা ফেরত পাবেন এই নিয়েও শঙ্কায় রয়েছে ব্যাংকগুলো।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যখন কোনো গ্রাহকের ঋণ দীর্ঘদিন খেলাপি থাকে সেই ঋণ পুনঃতফসিল করা ব্যাংকগুলোর জন্য প্রয়োজন। একই সঙ্গে আসল পেতে হলে কিছুটা সুদ মওফুফ করতে হয়।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেশের অর্থনীতির জন্যও দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে ধারণা করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন থেকে সঙ্কটে থাকা ব্যাংকিং খাতে অর্থের প্রবাহ বাড়বে। অর্থাৎ তারল্য সংকট দূর হবে। নতুন করে ব্যবসায় আসার সুযোগ তৈরি হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ঋণ পুনঃতফসিলের অবেদনকারীরা কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দফতরের নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

সূত্র মতে, অর্থমন্ত্রীর ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিলের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের পর নীতিমালা অনুযায়ী-২০১৯ সালে ৫০ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ঋণ পুনঃতফসিল। এ সুবিধার আওতায় পরবর্তীতে ২০২০ সালে কোভিডের বছরে কোনো খেলাপি ঋণ না থাকলেও, সেবছরে ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ১৩ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে গ্রাহকরা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ১২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে বড় অঙ্কের নগদ অর্থ ব্যাংকে আসে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাওয়ার চিন্তা করে। পাশাপাশি বন্ধ কলকারখানার চাকা সচল হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে এই আশা করেন সুযোগ পাওয়া গ্রাহকরা। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি কেউ কেউ ঋণ পুনঃতফসিল কিছুটা সুযোগ পেলেও অধিকাংশই বঞ্চিত হয়েছেন। অবার সংশিষ্ট ব্যাংকগুলোও তদারকি সংস্থা থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি আবার গ্রাহকরা কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। এবং দীর্ঘদিন ব্যাংকের নীয়ম-নীতির বা আমলাতন্তের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকায় ধার-দেনা করে অর্থ প্রদান করেও সুযোগের অপব্যবহারের স্বীকার হন। তবে যারাও কিছুটা সুযোগ পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ তদবির। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির, বর্তমান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এবং উপ-সচিব মো. জাহিদ হোসেনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সুবিধা পেয়েছে। এমনকি তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এই সুযোগের আওতায় কতটি অবেদন পড়েছিল এবং কতটি আবেদনের সুরহা হয়েছে তারও সঠিক হিসেব মিলেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে সব প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই বিশেষ তদবিরে হয়েছে। তদবিরের মাত্রা অনুযায়ী একেক প্রতিষ্ঠানের চিঠির ভাষাও পৃথক হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানি এনটেক্স গ্রুপকে তিন হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লিমিটেড। ‘ওয়ান টাইম এক্সিট’ নীতির আলোকে এই সুদ মওকুফ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগে যারা আবেদন করেছেন নিয়ম অনুযায়ী তারা সবাই একই ধরনের সুবিধা পাবেন। অথচ দেখা গেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ও সাবেক ও বর্তমান গভর্নর যেগুলোর সুপারিশ করেছেন এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছেÑ ‘ব্যাংকগ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিষয়টি সমাধানের’ আবার যে প্রতিষ্ঠানের জন্য সুপারিশ আসেনি অথচ একই গ্রাউন্ডে তারাও এই সুবিধা পাওয়ার দাবিদার তাদের চিঠিতে বলা হয়েছে আইন বা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে। একই বিষয়ে চিঠির ধরন একেক জনের জন্য একেক রকম। এছাড়া নিজস্ব তদবিরের প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া ব্যাংকের কাছ থেকে আসা চিঠির জবাব প্রদানেও মাসের পর মাস বিলম্ব করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ৬ মাসেও মিলেনি চিঠির জবাব। এসব বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব মো. জাহিদ হোসেনের স্বাক্ষরে যাওয়া চিঠির ভিন্নতা প্রসঙ্গে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইলে এসএমএস করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহের সঙ্গেও একাধিকবার সেল ফোনে কল ও এসএমএস এবং সরাসরি সাক্ষাতের কথা বলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে ঋণ খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগকে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে একটি বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত ছিল বলে উল্লেখ করে জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদ। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ঋণ পুনঃতফসীল নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন করলে দীর্ঘদিন ব্যবসা থমকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার সচল হওয়ার সুযোগ পাবে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে, বন্ধ কলকারখানার চাকা সচল হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান। মোটকথা আর্থিক খাতে গতি ফিরবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম ইনকিলাবকে বলেন, বিধি অনুযায়ী যে সব অবেদন পেয়েছি সেসব আবেদন সমাধান করার চেষ্টা করেছে বোর্ড। তবে অনেকক্ষেত্রে তদারকি সংস্থার সঠিক সিদ্ধান্ত না আসায় কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়েছে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপি তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেয় সরকার। এক্ষেত্রে তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপি ঋণ আছে তার হিসাব করা হবে। কোনো ঋণখেলাপি যদি মনে করেন এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয় সার্কুলারে। পরবর্তীতে নানা কারণে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাওয়ার সময় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।ওই সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হলে এককালীন এক্সিট সুবিধা বহাল থাকবে। যদিও এই মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। কারণ হিসেবে তিনি চিঠিতে বলেছিলেন, মহামারির কারণে অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যে ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি। তাই বিশেষ বিবেচনায় আরও এক বছর সময় বাড়ানোর দাবি করেন। যদিও ২০২১ সালের ডিসেম্বরের পরে ঋণ পুনঃতফসিলের সময় আর বাড়ানো হয়নি।

https://dailyinqilab.com/national/article/582374