আগস্টের মধ্যেই জলাবদ্ধতা থেকে দক্ষিণের মুক্তি : ডিএসসিসি মেয়র
২৫ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৭

এবার গ্রীষ্মের শুরুতেই ‘বর্ষার দুর্ভোগ’

কর্মমুখী উন্নত জীবন যাপনের আশায় দেশের আনাচে কানাচে থেকে প্রতিদিনই ভিটে-বাড়ি ছেড়ে রাজধানী ঢাকামুখী হচ্ছে অযুত নিযুত মানুষ। অতিরিক্ত মানুষের চাপে তিলোত্তমা এ নগরীতে জনজীবন আজ নানা কারণেই বিপর্যস্ত। সচ্ছল জীবনের আশায় রাজধানীতে আসা এসব মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ আর ভোগান্তির জীবনে প্রবেশ করছে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের পাশাপাশি নেই পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা। পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো অতি প্রয়োজনীয় সেবাও পাওয়া যায় না চাহিদা মোতাবেক। নিরাপদ যাতায়াত, যানজট, জলাবদ্ধতাসহ অপরাপর সমস্যা তো রয়েছেই তাদের তিলকে। এই পরিস্থিতির কোন একটাও বাদ পড়ছে না যারা আগে থেকেই বাস করছেন এই ঢাকাতে। পুরানো জনজীবনের সাথে নতুন জনজীবনের একাকার হয়ে যাওয়াটাও দুর্ভোগের মাঝেই। নানা ধরণের দুর্ভোগ কাউকেই রেহাই দিচ্ছে না। হোক নতুন নতুন জনজীবন কিংবা পুরানো জনজীবন। কোটি প্রাণের এই রাজধানীতে অন্তহীন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেখানে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি আর অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ যেন বেড়েই চলছে। তবে এ দুর্ভোগ লাঘবে সংশ্লিষ্টদের তেমন জনমুখী তৎপরতা চোখে পড়ে না।
রাজধানীতে গত কয়েকদিনের একটানা ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে মালিবাগ-মৌচাক এলাকার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কাদাপানিতে জনসাধারণের চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে ওই এলাকার সড়কগুলো। এতে ওই এলাকার বাসিন্দাসহ পুরো নগরবাসীই চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া সিটি করপোরেশনের খোঁড়াখুড়ির কারণে বেশকিছু সড়ক ও ফুটপাত দিয়ে চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
প্রতি বছর বর্ষা মওসুুমে রাস্তার ভাঙন ও জলাবদ্ধতার কারণে নগরীতে দুর্ভোগ দেখা দেয়। কিন্তু এবার ভরা গ্রীষ্মেই শুরু হয়েছে নগরবাসীর ‘আগাম দুর্ভোগ’। উন্নয়ন কাজের ধীর গতির কারণে ভাঙা রাস্তাগুলো সময়মতো সংস্কার না হওয়ায় এবং অনেক স্থানে পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা না থাকায় গ্রীষ্মকালেই দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যা। সাগরে নিম্নচাপের কারণে গত বুধবার বিকেল থেকে প্রতিদিন বৃষ্টি হওয়ায় দুর্ভোগের চিত্র এখন নগরজুড়ে। প্রধান সড়কগুলো চলাচলযোগ্য থাকলেও ভালো নেই পাড়ামহল্লার রাস্তাগুলো। অধিকাংশ ওয়ার্ডের রাস্তা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডে দক্ষিণ দিকের ফুটপাত খোঁড়াখুঁড়ি করে ড্রেনেজ পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। বৃষ্টির পানি ওই গর্তে ঢুকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে ফুটপাতটি। সেখান দিয়ে এখন হাঁটারও উপায় নেই। পূবালী মটরসের এক কর্মী জানান, কাজ নিয়মিত হচ্ছে না। একবার শুরু হয়ে দু’একদিন চলে, এরপর সপ্তাহ খানেক বন্ধ থাকে। কাজটি দ্রুত হলে বৃষ্টির আগেই শেষ হয়ে যেত।
শাহজাদপুরের বাঁশতলা থেকে বাজার পর্যন্ত রাস্তার বেহাল দশা চলছে কয়েক বছর ধরে। মেরামত না হওয়ায় রাস্তাটি ভাঙতে ভাঙতে এলাকাবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির কারণে চরমে উঠেছে মানুষের দুর্ভোগ। স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল হক বলেন, প্রায় দশ বছর আগে শাহজাদপুরের রাস্তা মেরামত করেছিল সিটি করপোরেশন। এরপর আর সংস্কার না হওয়ায় রাস্তার ঢালাই ভেঙে গর্তের সৃষ্টি করেছে।
ডিএনসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জাকির হোসেন বলেন, শাহজাদপুরের রাস্তাগুলোর অবস্থা অনেক দিন ধরেই খারাপ হয়ে আছে। চলতি অর্থবছর এগুলো মেরামত করা সম্ভব হবে না। আশা করি আগামী অর্থবছরে শাহজাদপুরের রাস্তাগুলো মেরামত করা সম্ভব হবে। এ জন্য প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে।
বৃষ্টির সময় ড্রেনের লাইনের কাজ চলছে গুলশান আবাসিক এলাকার ১০৩ নম্বর সড়কে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সিটি করপোরেশনের কাজের হিড়িক পড়ে গেছে। অথচ এ কাজগুলো যদি তিন-চার মাস আগে করা হত তাহলে বৃষ্টির কারণে মানুষের এত দুর্ভোগ হতো না।
বৃষ্টির কারণে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে ডিএনসিসির আওতাধীন মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, টোলারবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, আশকোনা প্রভৃতি এলাকায়। সময় মতো কাজ শেষ না হওয়ায় দুই সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ এলাকায় তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন এলাকার মধ্যে বৃষ্টির কারণে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মালিবাগ-মৌচাক এলাকার। মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ায় সড়কটি ভেঙেচুরে গেছে। সড়কের বড় গর্তগুলো হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। ফ্লাইওভার সংশ্লিষ্ট শান্তিনগর চৌরাস্তা, রাজারবাগ, মালিবাগ রেলগেট এলাকা দিয়ে চলাচলকারী মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শান্তিনগর থেকে মালিবাগ চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের দুপাশে কোনো কোনো অংশে হাঁটু পানি জমে আছে। পানি আছে মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক পর্যন্ত। এছাড়া মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটু পানি জমে রয়েছে।
মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে গর্ত খুড়ে মাটি তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। রাস্তায় রাখা হয়েছে পাইপসহ নির্মাণসামগ্রী। ফলে সড়কের ওই অংশে পথচারী ও যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। মৌচাক থেকে মালিবাগ চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের একপাশেও রাস্তা খুঁড়ে রাখায় লোকজনের চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। পানির মধ্য দিয়ে চলতে গিলে রিকশা উল্টে যাচ্ছে, অটোরিকশা বিকল হয়ে যাচ্ছে। আর যানজট লেগে থাকছে রাতদিন।
যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, পোস্তগোলা, দোলাইরপাড়, মিরহাজীর বাগ এলাকায় সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার ঢিমেতালে ড্রেনেজ লাইনের কাজ করতে থাকায় বৃষ্টির সময় সীমাহীন দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। দোলাইরপাড় হাই স্কুলের উত্তর সীমানা ঘেঁষা রাস্তাটি এখন আর চলাচলের উপযোগী নেই। চার মাস ধরে ড্রেনেজের কাজ শেষ না হওয়ায় মিরহাজীর বাগের অধিকাংশ রাস্তা বেহাল পড়ে আছে।
গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে বাসাবোর আহমদবাগে নকশী বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় পানি জমে রয়েছে। এতে চলাচলে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের। বিশেষ করে স্কুলগামী শিশুদের বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এছাড়া বৃষ্টি হলেই নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিল ও কমলাপুর এলাকায় মূল সড়কে পানি জমে যাচ্ছে। এ পানি সরতে ৫/৬ ঘন্টা লেগে যায়।
এ তো গেল যাতায়াতের দুর্ভোগ, রয়েছে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সমস্যাও। গত কয়েকদিন রাজধানীর গেন্ডারিয়া, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কালশী, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডসহ একাধিক এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাস ও পানির তীব্র সঙ্কট দেখা গেছে।
গত ১৬ এপ্রিল গেন্ডারিয়ায় ‘জনতার মুখোমুখি জনপ্রতিনিধি’ অনুষ্ঠানে মেয়র সাঈদ খোকনের সামনেই কলসী ও বালতি নিয়ে পানির দাবিতে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। জলাবদ্ধতার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, মালিবাগ, শান্তিবাগ, আরামবাগ ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। জরিপ করে এ বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে উন্নত ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। ’ চলতি বছর এসব স্থানের জলাবদ্ধতা ৬০ ভাগের বেশি কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘবে সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ সিটির পাশাপাশি ওয়াসাও নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ২০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে ড্রেন সংস্কারের কাজ চলছে।
তবে নগরীতে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার উন্নয়ন কাজে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ করেছেন নগরবাসী। তারা বলেন, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও গবেষণাভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুর্ভোগ আরও বাড়ছে।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ‘জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন’ কিনেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু তাতেও কোনো সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।
মেশিনটি কেনার সময় বলা হয়েছিল, এ মেশিন দিয়ে মাত্র ১০ মিনিটেই ১২০ মিটার দৈর্ঘের ড্রেনের ময়লা নিমিষেই পরিষ্কার করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এই মেশিনের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। এরপরও এসব বিষয়ে আশার কথা শোনালেন ঢাকার দুই মেয়র। তারা জানিয়েছেন, চলতি মওসুুমেই জলাবদ্ধতার হার ৬০ শতাংশ কমে আসবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামী বছর শতভাগ জলাবদ্ধতামুক্ত হবে রাজধানী।
ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এবার একটু আগেই বৃষ্টি চলে এসেছে। এতে ড্রেনেজ লাইনের উন্নয়ন কাজে সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের কারণে মালিবাগ ও শান্তিনগরসহ আশপাশের এলাকার ড্রেনেজ লাইন ব্লক হয়ে গিয়েছিল। এগুলোকে আমরা নতুন করে নির্মাণ করে দিচ্ছি। আশা করি আগামী দেড়-দুই মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
গতকাল সোমবার শান্তিনগর এলাকা পরিদর্শনে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এ সময় তিনি বলেন, ডিএসসিসির উন্নয়ন কাজের ফলে গত বছরের চেয়ে এ বছর জলাদ্ধতা অনেক কম। পুরো কাজ বাস্তবায়ন হলে এ চিত্র থাকবে না। আগামী আগস্টের মধ্যে জলাবদ্ধতা একেবারেই থাকবে না। মেয়র বলেন, শান্তিনগরে চলতি বর্ষা মওসুুমে ৮৫ ভাগ জলাবদ্ধতা কমেছে। চলতি বছরের জুন ও জুলাইয়ের মধ্যে শান্তিনগরের ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শেষ হবে। এরপর আর কোনো দুর্ভোগ থাকবে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/281162-