জামালগঞ্জের পাকনা হাওরের বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে ঢুকছে ঢলের পানি : নয়া দিগন্ত
২৫ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৫

পাকনা হাওরও তলিয়ে গেল

বাঁধ ভেঙে ডুবছে ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল

সুনামগঞ্জে জামালগঞ্জ উপজেলার বোরো ফসলের ভাণ্ডার খ্যাত ফেনারবাঁক ইউনিয়নের পাকনা হাওরের উরার বন্দ বাঁধ ভেঙে হাওরের প্রবেশ করছে পানি। আর কয়েক দিন পরই কৃষকের ঘরে ঘরে উঠত সোনালি ফসল। পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে পাউবোর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে হাওরের কাঁচা ধান। সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। গ্রামে গ্রামে চলছে হাহাকার আর আর্তনাদ। পাকনা হাওরে আবাদকৃত বোরো ছিল ৯,৪৫৫ হেক্টর (২৩,৩৫৫ একর)। ওই হাওরে পানি প্রবেশ করায় জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ও ভীম খালী ইউনিয়নসহ প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর বোরো জমি তলিয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরে এলাকার কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমে আর অকান্ত পরিশ্রমেও শেষ রক্ষা হয়নি। সোমবার ভোর সাড়ে ৫টায় উরার বন্দ বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল। কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টির কারণে পাকনা হাওরের কাউয়ারবাদা বাঁধ থেকে ঢাইল্যা স্লুইস গেট ও কাইল্যানী বাঁধ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার জায়গা মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। এলাকার হাজার হাজার কৃষক স্বেচ্ছাশ্রমে ওই বাঁধে দিন-রাত কাজ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি।
ফেনারবাঁক ইউপি সচিব অজিত কুমার রায় বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় পাকনা হাওরের উরার বন্দ বাধ টিকানোর জন্য এলাকার হাজার হাজার কৃষক কাজ করছিল। গত রাতেও বাঁধে পাহারা দিয়েছি; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভোর সাড়ে ৫টায় উরার বন্দ বাঁধটি ভেঙে পাকনা হাওরে পানি প্রবেশ করছে। গজারিয়ার গ্রামের কৃষক প্রবেল মিয়া বলেন, বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে ফসল রক্ষা করতে না পারাটা মনে থাকবে সারা জীবন। কৃষক হরমুজ আলী চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বলেন, ‘চোখের সামনে কাঁচা ধান পানির নীছে গেছে। গেলবার হিলে (শীলাবৃষ্টি) মারছে আর অহন মেঘের লাইগ্যা বাঁধ (বেড়িবাঁধ) ভাইংগা সব জমি পানির নীছে। দেনা কইরা কৃষিজমি করছিলাম, দেনাই দিমু কেমনে আর বউ-বাচ্চা নিয়া কেমনে বাঁচমু এই চিন্তায় আছি। ফেনারবাঁক গ্রামের তোফায়েল আলম ছানা বলেন, দেনা কইরা জমি করছিলাম, ধান তো পাকে নাই, কিছু ধান পানির ভয়ে কাটছি আধা পাকা। চার মণের মতো হবে কাজের লোকের বেতন দিমু কেমনে আর আমরাই কি খাইমু। আমরা তো আর লাইনেও দাঁড়াতে পারি না, সইতেও পারি না কইতেও পারি না। আমাদের কী হবে? সব ক্ষেত ফানির নীছে চইলা গেছে। আর ধান হওয়ার আশা নাই।’ কৃষক রহিম মিয়া বলেন, ‘আমরার ভাগ্য নিয়া দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার আর কমিটির লোকজন ছিনিমিনি খেলছে। হেরা আমরার পেটে লাথি দিছে। আল্লায় যেন এরার বিচার করে।
চৈত্রের শেষ দিকে অতিবর্ষণে প্রথম দফায় পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার-হাজার হেক্টর বোরো জমি। আংশিক জমি ভাসমান থাকলেও এবার বাঁধ ভাঙার কারণে এগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। বছরের একটি মাত্র বোরো ফসল বৈশাখে কাটা ও মাড়াই শুরু হয় এই অঞ্চলে। এবার হাওরের ফসল ডুবে কৃষকদের স্বপ্ন ও মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। হাজার হাজার কৃষকের কান্নায় হাওর এলাকার আকাশ এখন ভারী হয়ে উঠেছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী চলতি বোরো মওসুমে উপজেলার ১৩টি হাওরে বোরো ফসল আবাদ হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার হেক্টর (৪৮ হাজার ৩৪৫ একর) জমিতে। কিন্তু কৃষকদের বেসরকারি হিসাব মতে আমন ছাড়াই বোরো জমি প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর চাষ হয়েছে। এরই মধ্যে উপজেলার সর্ববৃহৎ ফসলি এলাকা ফেনারবাঁক ইউনিয়নের পাকনা হাওরের ৯,৪৫৫ হেক্টর (২৩,৩৫৫ একর), হালির হাওরে ৫,৪৯০ হেক্টর (১৩,৫৭৫ একর), শনির হাওর আংশিক ৬৪০ হেক্টর (১,৫৮০ একর), মহালিয়া হাওরে ২৫০ হেক্টর (৬২০ একর), চাঁদরা হাওর ৮০ হেক্টর (১১৫ একর), ধয়লার হাওর ১৫০ হেক্টর (৩৭০ একর), গজারিয়ার হাওর ৮১৫ হেক্টর (২০১৫ একর), দিরাই চাতল হাওর ৪ হেক্টর (৯৮৮ একর), সনোয়ার হাওর ২৩০ হেক্টর (৫৭০ একর), রৌয়ার হাওর ৪০০ হেক্টর (৯৮৮ একর), ডাকুয়ার হাওর ৫০০ হেক্টর (১২৩৫ একর), জোয়ার ভাঙার হাওর ৩৪৫ হেক্টর (৮৫৫ একর), ঘনিয়ার হাওর ৪০০ হেক্টর (৯৮৮একর) জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ হয়েছিল।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রসূন কুমার চক্রবর্তী বলেন, পাকনা হাওরের বাঁধ রক্ষায় আমি কয়েকবার সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। এলাকার কৃষকদের স্বেচ্ছায় শ্রম দেখে আমার বিশ্বাস ছিল বাঁধ ভাঙবে না, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রেরণ করেও শেষ রক্ষা হয়নি।
মাছ-হাঁসের পর হাওরে এবার মহিষের প্রাণহানী
ছাতক (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ছাতকে হাওরের পানিতে ডুব দিয়ে খাদ্য খাওয়ার সময় বিষাক্ততায় ছয়টি মহিষ মারা গেছে। উপজেলার নোয়ারাই ইউনিয়নের বাতিরকান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বাতিরকান্দি গ্রামের মৃত আবদুল কাহার (কালা মিয়ার) ছেলে লিলু মিয়ার তিনটি মহিষ ও এর আগের দু’দিনে আরো তিনটিসহ মোট ছয়টি মহিষ মারা গেছে। গত শনিবার থেকে মহিষগুলো চিরাচরিত নিয়মে গ্রামের পাশের নাইন্দার হাওরে পানিতে ডুব দিয়ে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে থাকে। এভাবে তিন দিনে মারা গেছে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের এসব মহিষ। যা ছিল পরিবারের একমাত্র সম্বল। ঘটনার পর বাতিরকান্দি গ্রামসহ নোয়ারাই ইউপির অনেকেই পানিতে বিষক্রিয়া বা বিষাক্ত হওয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করছেন। এভাবে ছাতক পৌরসভাসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে মারা গেছে হাঁস, মাছ, মহিষ, জলচর ও উভয়চরসহ গৃহপালিত আরো অসংখ্য প্রাণী। এ ব্যাপারে লিলু মিয়ার চাচাতো ভাই গোলাম মোস্তফা ও আলতাফ মিয়া তালুকদার জানান, সাতটি মহিষের মধ্যে ছয়টিই মারা যাওয়ায় পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। হাওরের ঘাস খেতে গিয়ে এগুলো মারা যায়। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভেটেরিনারি সার্জন (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি বিশেষজ্ঞ) ডাক্তার আবদুস শহীদ হোসেন বলেন, দূষিত কোনো পদার্থের জন্যই এ ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এ ব্যাপারে আরো উচ্চপর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/214940