১৭ জুন ২০২৩, শনিবার, ৬:৫৬

ঘূর্ণিঝড় কর্মসূচির সদর দফতর বিপজ্জনক ভবনেই ৩৫ কোটি টাকায় নতুন ভবনের প্রস্তাব

অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি পুরনো ভবনে ঝুঁকি নিয়ে চলছে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) প্রধান কার্যালয়ের যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম। ঢাকার বড় মগবাজারে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দফতরের ভেতরে সিপিপির প্রধান কার্যালয়। ভবনটি পুরনো হওয়ায় দুর্যোগ সহনশীল নয়। সম্প্রতি বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শন ও পরীক্ষা করে ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী ও বিপজ্জনক ঘোষণা করে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনটি যেকোনো সময় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। তাই ৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা খরচে বহুতলবিশিষ্ট সিপিপির নিজস্ব অফিস ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। যার নামকরণ প্রস্তাব করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সিপিপি ভবন নির্মাণ।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের পটভূমি থেকে জানা গেছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপসমূহ হতে প্রায়ই দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ইতিহাসের মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ দেশের প্রায় ১০ লক্ষাধিক উপকূলীয় মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এবং অনেক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। যার ফলে জাতিসঙ্ঘের অনুরোধে তৎকালীন লীগ অব রেড ক্রস উপকূলীয় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) কার্যক্রম চালু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপকূলীয় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সিপিপিকে সরকারি কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিপি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (তৎকালীন বাংলাদেশ রেড ক্রস) যৌথ কর্মসূচি হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সতর্ক সঙ্কেত প্রচার, দুর্গত জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা, উদ্ধার ও অনুসন্ধান, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, ত্রাণ বিতরণ ও পুনবার্সনে সহায়তা ইত্যাদি কাজে সিপিপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দফতরের অভ্যন্তরে একটি অতি পুরনো ভবনে অপরিসর স্থানে বর্তমানে কার্যালয়ের যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সম্প্রতি বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শন ও পরীক্ষা করে ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী ও বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দফতরের অভ্যন্তরে প্রায় ২৫.৩১ বিঘা নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রাণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ১০ কাঠা জমি সিপিপির কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য গত ২৬ আগস্ট ২০১৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ‘সিপিপি’র কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক কর্মসূচিটির সদর দফতরের ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে মোট ৩৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পের প্রধান কাজ হলো, সিপিপির সদর দফতরের জন্য ২৬ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বহুতলবিশিষ্ট ৬ তলা ভবন নির্মাণ। এই ব্যয় মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৭৩.৮৪ শতাংশ। উদ্দেশ্য, সিপিপির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে বহুতলবিশিষ্ট সিপিপির নিজস্ব অফিস ভবন নির্মাণ। উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের দুর্যোগ প্রস্তুতি, ঝুঁকি হ্রাস ও সাড়া প্রদান, শক্তিশালীকরণ ও ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ পদ্ধতির উন্নয়ন। স্বেচ্ছাসেবক সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক উৎকর্ষ সাধন।

মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সঙ্কেত প্রচার, দুর্গত জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা, উদ্ধার অনুসন্ধান, প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনে সহায়তা ইত্যাদি কাজে সিপিপির ভূমিকা সারা বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সিপিপির সাতটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীনে ১০টি জেলা, ৪২টি উপজেলা, ৩৭১টি ইউনিয়নে ৩ হাজার ৮১১টি ইউনিট ও ৭৬ হাজার ২২০ জন স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। দুর্যোগের পরিমাণ ও মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্যোগ ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং জনসম্পৃক্ততার কারণে কাজের পরিধি অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবর্তিত দুর্যোগ ঝুঁকি বিবেচনায় নদী তীরবর্তী আরো ছয়টি উপকূলীয় জেলায় সিপিপির কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা লক্ষাধিক হবে।

সংশ্লিষ্ট অধিদফতর বলছে, বর্তমানে ১৩টি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা যথা আবহাওয়ার খবরাখবর আদান প্রদান ও প্রয়োজনীয় গাইড লাইন প্রদানের জন্য ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুম থেকে ৪৬টি এইচএফ এবং ১২৬টি ভিএইচএফ ওয়্যারলেস স্টেশন ও দুইটি ডিএইচএফ রিপিটার স্টেশন কার্যকর রয়েছে। তা ছাড়া ছয়টি উপকূলীয় জেলায় সিপিপির কার্যক্রম সম্প্রসারিত হলে আরো ৫০টি এইচএফ ও ১৯০টি ভিএইচএফ স্টেশন কার্যকর হবে। অর্থাৎ ৬৬টি এইচএফ ও ২১৬টি ভিএইচএফ স্টেশন কার্যকর হবে। যা সচল ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিপিপি প্রধান কার্যালয়ে একটি অত্যাধুনিক ওয়ার্কশপ স্থাপন প্রয়োজন। এ ছাড়াও একটি অত্যাধুনিক ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন প্রয়োজন।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের খাদ্য ও সার-মনিটরিং অনুবিভাগ সূত্র জানায়, প্রকল্পটি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রকল্প প্রস্তাবনায় বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে। অর্থায়ন পরিকল্পনা, প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতা ইত্যাদি তথ্যাদি পুনর্গঠিত ডিপিপিতে সংযোজন করা নেই। লগ ফ্রেমওয়ার্ক এবং প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। ক্রয় পরিকল্পনায় যানবাহন ভাড়ার ক্ষেত্রে ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে, যা পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী সঠিক হয়নি। ক্রয় পরিকল্পনায় যানবাহন ভাড়ার একক ও পরিমাণে গড়মিল পরিলক্ষিত হয়। ক্রয় পরিকল্পনার পণ্য অংশে একক ও পরিমাণ হিসেবে থোক লেখা হয়েছে। যা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়াও ক্রয় পরিকল্পনায় ক্রয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এ বিষয়ে সভায় আলোচনা হতে পারে। প্রকল্পে কনসালটেন্সি অঙ্গে ৫৪ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। পরামর্শকের সংখ্যা ও সম্মানী সংক্রান্ত ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণসহ প্রস্তাবিত পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা, সংখ্যা, জনমাস, পরামর্শকের যোগ্যতা ও কর্মপরিধি (টিওআর) ইত্যাদি তথ্যাদি পুনর্গঠিত ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি।

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/756027