১৪ জুন ২০২৩, বুধবার, ১০:৫২

তিন সঙ্কটের মুখে অর্থনীতি

- মুদ্রানীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্বনীতি সঙ্কট নিয়ে বাজেট প্রস্তাব

দুর্বল রাজস্বনীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সামাল দেয়া ও দুর্বল মুদ্রানীতি- এই তিন সঙ্কটে রয়েছে দেশে অর্থনীতি। আর এই সঙ্কটের মধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। এ বাজেট বাস্তবায়ন দুরূহ বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালত ড. আহসান এইচ মসনুর ও ড. মোহাম্মদ এ রাজ্জাক। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক চাপের কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলে এটি গরিব মানুষকে প্রভাবিত করে। যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ব্যয় বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গেলে আমরা সেটি অর্জন করতে পারব না। যে বছর মূল্যস্ফীতি বেশি হয়, সে বছর যদি প্রবৃদ্ধি বেশি চাই, সেটি সাংঘর্ষিক। এ পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্যমাত্রা।

রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘বাজেট পরবর্তী আলোচনা’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব অভিমত দেন ড. আহসান মনসুর। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মাদ এ রাজ্জাক।

উপস্থাপনায় ড. মোহাম্মাদ এ রাজ্জাক বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যেটি লক্ষ্যমাত্রার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের অবনতি হবে বাকি সময়ে। জোরেশোরে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চাপ দেয়া হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৫৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময় এটি ছিল ৬৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা সুদের হার বাড়াতে পারতাম। সে সুযোগও হারালাম। যে বছর মূল্যস্ফীতি বেশি হয়, সে বছর যদি প্রবৃদ্ধি বেশি চাই, সেটি সাংঘর্ষিক। এ পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্যমাত্রা। বিশে^র বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আর আমাদের দেশে প্রায় ১০ শতাংশ। মুদ্রানীতির কোনো পদক্ষেপই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজে আসছে না।

ড. রাজ্জাক বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই বাজেটে ঘাটতি অনেক বেশি। বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে কাটছাঁট করতে হবে। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে মোটা দাগে তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জ তিনটি হলো, প্রথমত, রাজস্ব নীতি। সরকার যে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য মাত্র নিয়েছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, মুদ্রানীতি। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে তিনটি পরামর্শ দেয়া হয় সরকারকে। সেগুলোর প্রথমটি, বাজেটে ঘাটতি কমাতে হবে। তার জন্য সরকারি খরচ কমাতে হবে। পাশাপাশি সরকারের নেয়া বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) কমাতে হবে। দ্বিতীয় পরামর্শটি হলো, মূল্যস্ফীতি। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আনার যে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার তা বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। তৃতীয়টি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভ ভালো রাখতে হলে ডলারের মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

উপস্থাপনায় বলা হয়, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২৭.৪ শতাংশ হওয়া দূরহ। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যারা ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২৮ শতাংশ করতে পারে। প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রাগুলো দেয়া হয়েছে তা অবাস্তব। আমাদের দেশের টেন্ডেন্সি আছে দেশ থেকে টাকা বের করে নেয়ার। ফরমাল চ্যানেলেই টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। যার কারণে এ বছর রেমিট্যান্সও অল্প বাড়বে। এত লোক বিদেশ যায় রেমিট্যান্স কেন বাড়ছে না? এটি সন্দেহজনক। রিজার্ভের বিষয়ে বলা হয়েছে, কত রিজার্ভ থাকা উচিত ছিল এখন কত, জুনের মধ্যে রিজার্ভ আরো ৫ বিলিয়ন বেশি থাকার কথা ছিল। বাজেটে ব্যয়ের সংস্থান সম্পর্কে পিআরআই বলছে, বাজেট সংস্থানে গতবারের সাথে খুব বেশি পার্থক্য নেই। বাজেট সব সময় আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি না। এমন অ্যালোকেশন বা বরাদ্দ তখন হয়, যখন সরকারের কোনো পথ থাকে না।

প্রবন্ধে ড. রাজ্জাক বলেন, সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদজনিত ব্যয় ধরেছে মোট বাজেটের ১২ ভাগ। এটি ১৫ ভাগ হলেও অবাক হবো না। ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নেয়ার পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এরকম ঋণ নিলে সামষ্টিক অর্থনীতি বিপাকে পড়বে। গত ৫ দশকে যে ঋণ নেয়া হয়েছে, গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সে পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ১১ মাসে এনবিআর তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। বাকি এক মাসে লক্ষ্যমাত্রার ২৪ শতাংশ পূরণ করতে হবে, তা কার্যত অসম্ভব। আমরা বৈদেশিক ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছি। বিদেশী দেনার সুদের হার বেড়েছে। এ বছর ৮০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হবে। আরো কিছুদিন পর এক ট্রিলিয়ন টাকা লাগবে শুধু সুদ পরিশোধে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনেক দিন ধরেই সরকার সতর্কবাণী উপক্ষো করে আসছে। রাজস্বনীতি নিয়ে যে সতর্কবাণী সেটি আজকের দেয়া না। ৮ থেকে ১০ বছর এ সতর্কবাণী দিয়েই যাচ্ছি আমরা। সরকার এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আজকে সরকারের সক্ষমতা কমে আসার মূলে ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত না করা। এটি যদি এখন চিহ্নিত করা হয়, আইএমএফ বলছে, এক বছর লাগবে প্রস্তুতি নিতে। তিন থেকে পাঁচ বছর লাগবে বাস্তবায়ন করতে। আমাদের দেশে ছয় থেকে সাত বছরও লাগতে পারে।

তিনি বলেন, সরকারের প্রশাসন ব্যয় কমানো যায়। সরকার অনেক খাতেই বাড়াতে পারে কমাতে পারে। এখন যদি আমি না কমাই তাহলে সামিষ্টক অর্থনীতি জটিল হয়ে পড়বে। এখন আমাকে কষ্ট নিতেই হবে। এসব পদক্ষেপ না নিয়ে বসে থাকাটাও ‘ক্রনিক পেইন’ হবে। তার মতে, সামনে নির্বাচন। বাজেট বাস্তবায়নে আরেকটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। এখন এক্ষেত্রে সরকারের পলিসি প্যারালাইসিস দেখা দিয়েছে। তারা দোটানায় আছে, আমরা কি নির্বাচন পর্যন্ত ধরে রাখব নাকি তারপর ছেড়ে দেবো। তত দিনে কি অবস্থা হবে সেটি কেউ বলতে পারে না। সেটি যে ভালোর দিকে যাবে না সেটি অনুমেয়।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অনেক দিন ধরেই দেশের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। যেমন কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম, এক বছরের মধ্যে এটি সামাল দেয়াও কঠিন। সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্কটে দুটো জিনিস চিন্তা করতে হয়, একটি হচ্ছে ফরেন রিজার্ভে যদি চাপ থাকে দায় দেনা ঠিক মতো পরিশোধ করতে না পারলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটবে। আরেকটি ব্যাপার হলো মূল্যস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলে এটি গরিব মানুষকে প্রভাবিত করে। যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ব্যয় বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গেলে আমরা সেটি অর্জন করতে পারব না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/755304