১৪ জুন ২০২৩, বুধবার, ১০:৪৫

দেশে তালাক বৃদ্ধির নেপথ্যে আধুনিকায়নের কু-প্রভাব

আধুনিকায়নের ভালো দিকের পাশাপাশি খারাপ দিকও আছে। আধুনিকায়ন যেমন মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েছে তেমনি এর ক্ষতিকর দিকগুলো প্রভাবিত করছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। আধুনিকায়ন যেসব সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে অন্যতম, তালাকের হার বৃদ্ধি। গত এক বছরে দেশে তালাকের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৪ শতাংশে। গত বছরের চেয়ে যা ০.৭ শতাংশ বেশি। সম্প্রতি স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্সের একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। গ্রামে এর হার ২০২২ সালে ০.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১.৪ শতাংশে পৌঁছেছে। তালাকের এই বর্ধিত হারের কারণ অনলাইন আসক্তি, সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরত্ব হলেও মূলত নগরায়ণ ও আধুনিকায়নের কু-প্রভাবকেই বেশি দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে তালাকের এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও উচ্চতর সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের সাথে। তিনি বলেন, একটা সমাজ ট্রেডিশনাল সোসাইটি (ঐতিহ্যগত সমাজ) থেকে আধুনিক সমাজের দিকে এলে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নাগরিক অধিকার এগুলো যখন বৃদ্ধি পায় তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব বিষয় বেড়ে যায়। ঐতিহাসিকভাবে মেয়েরা হয়তো স্বামীর যেকোনো বিষয় সহ্য করে, কিন্তু সে যখন আধুনিকায়নের সাথে সম্পৃক্ত হয় তখন তার মধ্যে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি হয়। ফলে এই কনফিক্টটা (মতপার্থক্য) বেড়ে যায়। এ ছাড়াও এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশনশিপ (পরকীয়া) বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন হওয়াতে দেখা যাচ্ছে অনেক নারী বাসায় ঠিকমতো সময় দিচ্ছে না। এগুলো শুনতে হয়তো অন্যরকম মনে হবে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসবের ফলেই সংসারে প্রচণ্ড কনফিক্ট হচ্ছে এবং ডিভোর্স বেড়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, জীবনধারণের পদ্ধতি পরিবর্তন ও টেকনোলজির কারণেও সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আধুনিকায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে টেকনোলজির ছোট ছোট বিষয়ের কারণে যেমন, স্বামীদের পর্ণগ্রাফিক আসক্তি, পরকীয়ার সন্দেহ, স্বামী বা স্ত্রীর সংসারে সময় দিতে না পারা ইত্যাদি কারণেও ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। ডিভোর্সের অর্থনৈতিক কারণ আমি মনে করি, যৌতুক বা এই ধরনের কারণ যেগুলো ছিল সেগুলো হয়তো গ্রামের দিকে এখনো আছে কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ নয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী শহরের তুলনায় গ্রামে তালাক বৃদ্ধির সাথে দ্বিমত পোষণ করে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, নিশ্চয়ই গ্রামে আগের তুলনায় তালাকের হার অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সেটা শহরের তুলনায় বেশি, এটা আমার কাছে ব্যাখ্যাযোগ্য মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয় এই হারটা শহরেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ যেই ডিভোর্স গুলো হচ্ছে, আর যেসব কারণে হচ্ছে সেসব কারণ শহরের সাথেই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তালাক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মানুষের দূরত্ব উল্লেখ করে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদ বলেন, তালাক মূলত ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ নয়, বরং এটি অপ্রিয় হালাল। আল্লাহ তায়ালা কিছু বিষয় মানুষের জন্যে হালাল করেছেন কিন্তু সেটাকে অপ্রিয় হালাল বলেছেন। তালাক হলো সেরকম একটা বিষয়। তালাক হালাল এর মানে এই নয় যে, যেনতেন কাজে, কথায় বা আচরণে পরিবার ভেঙ্গে যাবে। বর্তমান যা হচ্ছে, কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে সমাধানের চেষ্টা না করে সরাসরি তালাক দিয়ে দিচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় তাদের মধ্যে যে জীবনবোধ সেটা থাকে না, ফলে পরকালীন জীবনের থেকে তারা দুনিয়াবি জীবনকে প্রাধান্য দেয়। উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় নারী ও পুরুষরা তাদের অধিকারগুলো বোঝে। কিন্তু এসব অধিকারকে তারা ভুলভাবে প্রয়োগ করে।

তিনি বলেন, এখন সামাজিক অবক্ষয়গুলো সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন আকাশ সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের জীবনবোধে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে তারা কোনো ধৈর্য বা সহ্য না করেই এই পথ বেছে নিচ্ছে। পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে অনেক সময় নৈতিক অবক্ষয়ের কিছু বিষয় পাওয়া যায়, যার কারণে তুলনামূলক ভালো জীবনের আশায় বা সাময়িক সুখ চিন্তা করে তারা বর্তমানকে উপেক্ষা করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয় যে তাদের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল এটা তারা পরবর্তীতে বুঝতে পারে এবং অনুশোচনা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে যে ডিভোর্সগুলো হয় সেগুলোতে সাইকোলজিক্যাল কারণ তেমন থাকে না। এগুলো মূলত সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণে হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিন্তু ডিভোর্সগুলো আসছে নারীদের দিক থেকে। আগে দেখা যেত স্বামীর অত্যাচার, নির্যাতন, অথনৈতিক সমস্যা বা এই জাতীয় সমস্যাগুলো আগের মহিলারা মেনে নিত বা সহ্য করত, কাউকে বলত না। কিন্তু এখন মহিলারা এটা মেনে নেয় না, মেনে নিলে তাদের স্বাধীনতা নষ্ট হবে বলে তারা মনে করে। বিশেষ করে যারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও উচ্চশিক্ষিত তাদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়।

তালাকের মতো সামাজিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাস থেকে সমাজকে বাঁচাতে সামাজিক সচেতনতা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দেন এই বিশেষজ্ঞরা। ড. জিয়া বলেন, এটা কমানোর জন্য আমি বলব সচেতনতা খুব দরকার। স্বামী-স্ত্রীর জীবনধারণের পদ্ধতিতে যেসব পরিবর্তন আসছে এগুলো চিহ্নিত করে উভয়ের সামঞ্জস্য আনা দরকার। আর কাউন্সিলিং এই ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আধুনিক সমাজে এগুলো কমিয়ে আনার জন্যে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিংয়ের চাহিদা অনেক বেশি।

ড. আব্দুর রশীদ বলেন, কুরআনে সংসার চালাতে গিয়ে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে উভয় পরিবারের দুজন মুরব্বিকে দায়িত্ব নিয়ে এটা সমাধান করতে বলা হয়েছে। আমাদের দেশে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, পুরুষরা মুরুব্বিদের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা কমানো উচিত। শিক্ষার হার শুধু নয়, মানসম্মত নৈতিক শিক্ষা তথা সুশিক্ষাও বৃদ্ধি করা দরকার। আর সংসারের ব্যাপারে পুরুষদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/755327