১৩ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:০১

কোরবানির ঈদের আগে বাড়ল আদার ঝাঁজ

কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আদার বাজারে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে আমদানি করা আদা আড়তে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন কেজি ২৫০ টাকায় পৌঁছেছে। এ জন্য হঠাৎ সরবরাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোরবানি ঈদের আগে পাইপলাইনে থাকা আদা বাজারে এলে সরবরাহ সংকট আর বাড়বে না।
আড়তেও আদার দাম বাড়ার কথা নয়। এ জন্য সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক রাখতে হবে।

আদার দাম নিয়ন্ত্রণে ১০ দিন আগে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের কয়েকটি আড়তে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছিল। সিলগালা করেছিল আড়ত।

তখন মিয়ানমার থেকে আসা আদা আড়তে কেজি ১৮০ টাকা দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। এতে কিছুদিন সুফলও পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রামের উপপরিচালক ফয়েজ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূল্য নিয়ে কারসাজি আছে কি না, তা যাচাই করতে কেন্দ্রীয় অফিসের নির্দেশনা আছে। কিন্তু বাজারে আদার সরবরাহ থাকতে হবে, তবেই তো আমরা বাজার তদারক করতে পারব।
সার্বিক বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি।’

দেশে আমদানির অর্ধেকের বেশি ছিল চীনা আদা। কিন্তু দুই মাস ধরে চীন থেকে আদা আমদানি পুরোপুরি বন্ধ। বিকল্প হিসেবে মিয়ানমার থেকে স্থলবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আদা আসছিল। এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার থেকেও আদা আসছে না।

ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার আদা দিয়ে সেই ঘাটতি মেটানো হচ্ছিল। কিন্তু তিন দিন ধরে বাজারে আমদানি করা আদার সরবরাহ নেই। এই অজুহাতে খাতুনগঞ্জে পাইকারিতেই কেজি ১৮০ টাকা থেকে বাজারে নতুন করে দাম বেড়ে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আদা।
জানতে চাইলে মিয়ানমার থেকে আদার আমদানিকারক মনজুর মোরশেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীন থেকে আদার মূল সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পর বাজারে মিয়ানমারের আদার সরবরাহ বেশি ছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার থেকে আদা আমদানি করতে পারছি না। মিয়ানমারের আদা চীন ও পাশের দেশ বুকিং দিয়ে রাখছে। এর ফলে দাম বেড়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘তিন দিন আগেও মিয়ানমার থেকে আদা কিনতে গেলে কেজি ২০০ টাকার নিচে মিলছিল না। এর সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ খরচ, পরিবহন খরচ, আড়তদারি যোগ করলে ২২০ টাকা পড়বে। এ জন্য আদা আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদা আমদানিতে ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি, ডলারের বিনিময়মূল্য বেশি থাকা এবং শতভাগ মার্জিন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় বড় আমদানিকারকদের বেশির ভাগই আদা আনতে পারেনি। এতে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে শীর্ষ কর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই শুধু আদার ঋণপত্র খুলতে পেরেছেন। ফলে আদা যাঁরা আমদানি করেছেন, তাঁরা বাজারে সরবরাহ দিচ্ছেন ধীরে। এতে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।

খাতুনগঞ্জ কাঁচা পণ্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস কালের কণ্ঠকে বলেন, তিন দিন ধরে বাজারে আদার সরবরাহ নেই। এখন যে আদা আছে, সেগুলো এক সপ্তাহ আগে আমদানি করা। গতকাল বাজারে মিয়ানমারের আদা কেজি ২২০ টাকা ও ইন্দোনেশিয়ার আদা ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। নতুন করে বাজারে আদা এলে হয়তো দাম কমবে।

আদা, রসুন, পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য আমদানি নিয়ে বেশ খোঁজখবর রাখেন অ্যাগ্রো কমোডিটি ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি রেজাউল করিম আজাদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে এক মাস ধরে আদার বুকিং রেট টন দুই হাজার ৬০০ ডলারের নিচে নামছে না। ডলারের বিনিময়মূল্য ১১২ টাকা হিসাব করে প্রতি কেজি আদার দাম পড়বে ২৯১ টাকা। এর সঙ্গে কেজিপ্রতি ২২ টাকা শুল্ককর যোগ করলে দাম দাঁড়াবে ৩১৩ থেকে ৩১৫ টাকা। এই দরে আদা আনলে কে খাবে? এ জন্য চীন থেকে আমদানির ঝুঁকি কেউ নিচ্ছে না।’ তিনি বলেন, বিকল্প দেশ হিসেবে এত দিন ভিয়েতনামের আদা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। এখন ভিয়েতনামে আদা আর নেই। আগের বুকিংয়ের আদাগুলোই দেশে আসছে। তবে ইন্দোনেশিয়া এখনো ভালো সরবরাহ দিচ্ছে; দামও এক হাজার ৫০০ ডলারের নিচে। এই দামে আদা আনতে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত খরচ পড়বে কেজি ১৮৩-১৮৫ টাকা। সেগুলো আনতেই এখন অনেকেই আগ্রহী হচ্ছে। তাঁর মতে, কোরবানি ঈদের আগেই পাইপলাইনে থাকা আদা বাজারে এলে সরবরাহ সংকট আর বাড়বে না। ফলে আড়তে আদার কেজি ২৫০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এ জন্য সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক রাখতে হবে।

মিয়ানমারের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে যে আদা আমদানি হচ্ছে, সেগুলো আসছে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। গত ২৭ মে তাজ গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের একটি বিল অব এন্ট্রি যাচাই করে দেখা গেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের ২৬ হাজার কেজি আদার চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্কায়ন হয়েছে কেজি ১০৩ টাকা থেকে ১৪১ টাকায়। সেই একই আদা আড়তে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৫০ টাকায়।

জানতে চাইলে এক আমদানিকারক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যত দরেই আমদানি হোক না কেন, কাস্টমস একটি নির্ধারিত দরেই শুল্কায়ন করে। এই কারণে দাম ১৪১ টাকার ওপরে ওঠেনি। বাস্তবে কেনা দাম ধরলে শুল্ককর, ডলারের বিনিময়মূল্য ও পরিবহন খরচ যোগ করলে দাম পড়বে কেজি ২০০ টাকা। কিন্তু সরবরাহ যদি ভালো থাকত, তাহলে ওই দরেই খাতুনগঞ্জে আদা মিলত। সরবরাহ ভালো না হওয়ায় যে যার মতোই বিক্রি করছে।’

কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর আদার চাহিদা প্রায় দুই লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপন্ন হয় মাত্র ৮০ হাজার টন। চাহিদার বাকি আদার বেশির ভাগ আমদানি হয় চীন থেকে, যা মোট আমদানির ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ আদা আসে ভারত ও মিয়ানমার থেকে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদা উৎপন্ন হয় তিন পার্বত্য জেলা—বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

কৃষি বিভাগের হিসাবে প্রতি মাসে দেশে আদা প্রয়োজন ২০ হাজার টন। আর কোরবানি ঈদে সেটির চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
বন্দরের হিসাবে, ২০২২ সালে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আদা আমদানি হয়েছিল ৩৪ হাজার ৮৭৪ টন। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ছয় হাজার ২১৬ টন। চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরে ভারত এবং মিয়ানমার থেকেও প্রচুর আদা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে। সেসব আদার হিসাব অবশ্য পাওয়া যায়নি।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/06/13/1289346