২৫ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪৯

বিআরটিসির খবর কী

নতুন কেনা বাসেরও ৩০ ভাগ বিকল, মেরামতের টাকা নেই

ধুঁকছে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা 'বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন' (বিআরটিসি)। প্রতিষ্ঠানটির আয়ের মূল উৎস বাস থেকে প্রাপ্ত ভাড়া। বিআরটিসির তথ্যানুযায়ী, সংস্থার বহরে থাকা এক হাজার ৫৩৮টি বাসের ৫৪৫টিই বিকল। তবে বাস্তব অবস্থা আরও খারাপ। নতুন কেনা বাসেরও ৩০ ভাগ বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। অর্ধেকের বেশি পদ শূন্য। যে জনবল আছে, তাদেরও নিয়মিত বেতন হচ্ছে না। বিকল বাস মেরামতের টাকা কোথায়?


বিআরটিসির অপারেশন শাখার হিসাবে রাজধানীতে গণপরিবহন হিসেবে সংস্থাটির ৫৮০টি বাস চলাচল করে। তবে এর বড় অংশই বিকল। সচল বাসের সংখ্যা কম থাকায় রাজধানীতে পরিবহন সংকটে যাত্রীদের জন্য বিকল্প হতে পারে না বিআরটিসি। সম্প্রতি 'সিটিং সার্ভিস'বিরোধী অভিযান চলাকালে অনেক পরিবহন মালিক রাস্তায় বাস নামাননি। এ সংকটেও বিআরটিসি বাসযাত্রীদের ভরসা হতে পারেনি।


বিআরটিসির অপারেশন শাখার তথ্যানুযায়ী, গত সাত বছরে করপোরেশনের বহরে যুক্ত হয়েছে ৯৫৮টি বাস। সরকার এসব বাস কিনে দিয়েছে বিআরটিসিকে। তার পরও প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।


নতুন বাসের ৩০ ভাগই বিকল: ৯৫৮টি বাসের ৩৩টি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। বাকি ৯২৫টি বিআরটিসির বহরে যুক্ত হয়। এসব বাসের আয়ুষ্কাল কমপক্ষে ১৫ বছর। কিন্তু বাস কেনার সাত থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই ৯২৫ বাসের ২৭৩টি বিকল হয়ে পড়েছে। এসব বাস মেরামতে প্রয়োজন অর্ধশত কোটি টাকা। টাকা না থাকায় মেরামত হচ্ছে না। ডিপোতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে শতকোটি টাকার নতুন ২৭৩টি বাস। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপির ডাকা অবরোধের আগুনে পুড়ে যায় আরও নয়টি নতুন বাস। এগুলো মেরামতেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে।


নতুন বাসের ২৭৩টিই বিকল হয়ে পড়াকে অস্বাভাবিক মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, একই আবহাওয়ায় এবং একই মানের সড়কে বেসরকারি পরিবহনের বাস ২০ বছর পরও চলে; কিন্তু সরকারি বাস তিন-চার বছরেই বিকল হয়ে পড়বে কেন?


বিআরটিসির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের দাবি, গাড়ি বিকল অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, 'রাস্তায় চললে নানা কারণে বিকল হতে পারে গাড়ি।' তিনি জানান, চীন থেকে যেসব গাড়ি কেনা হয়েছিল, সেগুলো ভালো মানের ছিল না। কিন্তু কোরিয়ান বাস বিকল হওয়ার বিষয়ে জবাব নেই তার কাছে। তিনি বলেন, 'প্রতিটি গাড়ি বিকল হওয়ার কারণ ভিন্ন। এগুলো জেনে বলতে হবে।'


নিয়মানুযায়ী, সরকার বিআরটিসিকে বাস, ট্রাক কিনে দেয়। যানবাহন পরিচালনা থেকে প্রাপ্ত আয়ে সংস্থাটির ব্যয় নির্বাহ করে। বিআরটিসির চেয়ারম্যান সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারি বরাদ্দের দিকেই তাকিয়ে আছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের টাকার সমস্যা আছে। যেসব গাড়ি বসে আছে, সেগুলো ভারি মেরামতে ৫০ কোটি টাকা দরকার। এ টাকা পেলে মেরামত করা যাবে।'


বিকল বাসের ভাগাড় বিআরটিসি: ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে চীন থেকে ২৭৫টি সিএনজিচালিত বাস কেনা হয়। ৩০টি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। বাকি ২৪৫টি যুক্ত হয় বিআরটিসির বহরে। এসব বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। এ হিসাবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলার কথা। কিন্তু সচল রয়েছে মাত্র ১২১টি। বাকিগুলো এর মধ্যে বিকল হয়ে পড়েছে। ১১৫টির ভারি মেরামত প্রয়োজন। ৬টি বাস মেরামতেরও অযোগ্য।


২০১৩ সালে ভারতীয় ঋণে দেশটি থেকে ৩০৪ কোটি টাকায় ২৯০টি দ্বিতল, ৮৮টি এসি এবং ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনা হয় বিআরটিসির জন্য। প্রতিটি আর্টিকুলেটেড বাসের দাম পড়ে এক কোটি ১১ লাখ টাকা করে। এ বাসেরও আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। বিআরটিসির হিসাবেই সাড়ে তিন বছরেই সাতটি বাস বিকল হয়ে পড়েছে। আরও সাতটির মেরামত প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন ২০ কোটি টাকা। টাকার সংস্থান করতে না পারায় আর্টিকুলেটেড বাস মেরামত করতে পারেনি বিআরটিসি। দ্বিতল বাসের ২২টি বিকল পড়ে আছে। একই সময়ে কেনা অশোক লেল্যান্ডের একতলা ৮৮টি এসি বাসের চারটি ভারি মেরামত প্রয়োজন। এগুলোও ডিপোতে বিকল পড়ে রয়েছে।


কোরিয়া সরকারের ঋণে দেশটি থেকে ২০১১ সালে ২৫৫টি বাস কেনে বিআরটিসি। এর মধ্যে ১০০টি এসি ও ১৫৫টি নন-এসি। এতে ব্যয় হয় ২৪৩ কোটি টাকা। দুটি নন-এসি বাস অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। বাকি ২৫৩টি যুক্ত হয় বিআরটিসির বহরে। নন-এসি ১০৩টি বাসের ৪৪টি বিকল হয়ে পড়েছে। এগুলোর ভারি মেরামত প্রয়োজন। বিআরটিসির হিসাবে, ১৫০টি এসি বাসের ১১৭টি সচল রয়েছে। ৩২টি বিকল। বাকি একটি মেরামতেরও অযোগ্য।


বিআরটিসির বহরে থাকা পুরনো বাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত 'ভলভো'। ২০০২ সালে সুইডেন থেকে ৫০টি ভলভো বাস কেনা হয়। সেই সময়েই অত্যাধুনিক এসব বাসের প্রতিটির দাম পড়েছিল ১ কোটি ৩ লাখ টাকা করে। ৫০টি বাসের ৪৯টিই সাত বছর ধরে বিকল পড়ে রয়েছে ডিপোতে। গত বছর মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় ৩২ কোটি টাকা সরকারের কাছে চেয়েছিল বিআরটিসি। টাকা না পাওয়ায় আর মেরামত করা হয়নি।


বিআরটিসির কারিগরি শাখার হিসাবে, সচল বাসের সংখ্যা ৮৭৯টি। গত সেপ্টেম্বরেও এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪৯। কিন্তু দৈনিক গড়ে অর্ধেক বাসও রাস্তায় নামে না। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, গত দুই বছরে একদিন সর্বোচ্চ ৮২১টি বাস রাস্তা নেমেছিল। কখনও ৪০৬টি বাস চলার নজির রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার ডিপো পরিদর্শন করে বাস বসিয়ে রাখার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কোনো ফল হয়নি। বিআরটিসি সূত্র জানায়, ডিপোগুলো ইচ্ছা করেই বাস বন্ধ রাখছে। গত বছরের আগস্টে সংস্থাটির নিজস্ব অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে আসে।


মেরামতের টাকা নেই, ডিপোতে বকেয়া বিপুল টাকা: বিআরটিসির আয় আসে ২১টি ডিপোর মাধ্যমে। কিন্তু ডিপোগুলোতে কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে রয়েছে। বিআরটিসির ডিপোগুলোতে বকেয়া পাওনার পরিমাণ ১৯ কোটি টাকার বেশি।


বিআরটিসি সূত্র জানায়, এসব টাকা ডিপোর কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেছেন, নয়তো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করেছেন। কুমিল্লা ডিপোতে বাস থেকে আয়ের ৩ কোটি ১ লাখ ৪ হাজার ৯৮৫ টাকা বিআরটিসি অ্যাকাউন্টে জমা পড়েনি। মতিঝিল ডিপোতে এমন টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৫ হাজার ১৮৪। বরিশাল, চট্টগ্রাম ও উথলী (গাবতলী) ডিপোতেও কোটি টাকার বেশি অনাদায়ী। তবে মতিঝিল ডিপোর বর্তমান ম্যানেজার আশরাফুল আলম দাবি করেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। আগের ম্যানেজারদের সময়ে এ টাকা বাকি পড়তে পারে।


১৭টি ডিপোতে বকেয়ার পরিমাণ ১০ কোটি ৫৫ লাখ ২৩ হাজার টাকা। নিয়মানুযায়ী, দিন শেষে বাস ও ট্রাকের চালকরা ডিপোতে দৈনিক জমার টাকা দেন। চালকরা এ বিপুল অঙ্কের টাকা জমা দেননি। হরতাল-অবরোধে গাড়ি চালানো যায়নি- এমন সব অজুহাতে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। সংস্থাটির এক পরিচালক বলেন, ২০১৩ সালের শেষ দিকে এবং ২০১৫ সালের শুরুতে হরতাল-অবরোধ ছিল। চলতি বছর হরতাল ছিল না। কিন্তু এ বছর ব্যাংকে টাকা জমা না রাখার কোনো কারণ নেই। সর্বোচ্চ বকেয়া পড়েছে বগুড়া বাস ডিপোতে, ২ কোটি ৩১ লাখ ৯ হাজার ৮৯৮ টাকা। মতিঝিলে বকেয়া রয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৪ হাজার ৯০০ টাকা।


বিআরটিসির চেয়ারম্যান বলেন, যে টাকা বকেয়া রয়েছে, এর কিছু অংশ তেল ও যন্ত্রাংশ কেনায় ব্যয় হয়েছে। অনুমতি ছাড়া ব্যয় করায় বকেয়া দেখানো হয়েছে। বাকি যে টাকা ডিপোগুলোতে বকেয়া পড়েছে, তা আদায়ের চেষ্টা চলছে। বকেয়া বেতনও পরিশোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

http://bangla.samakal.net/2017/04/25/287921#sthash.R8E8BNo2.dpuf