৯ জুন ২০২৩, শুক্রবার, ৮:২৭

গরম ও লোডশেডিংয়ে খামারিদের মাথায় হাত

বৈরী আবহাওয়ায় কঠিন সময় পার করছে দেশ। তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস করছে প্রাণিকুল। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এতে বিপদে পড়েছেন খামারিরা। গরমে মারা যাচ্ছে মুরগি। কমেছে মাংস ও ডিম উৎপাদন। গরু-ছাগল বাঁচাতে খামারিদের জেনারেটরের পেছনে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এতে কোরবানির পশুর দাম বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হ্যাচারিগুলোতে মাছের পোনা উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ভর্তুকির দাবি করছেন অনেক খামারি।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চর আমান উল্যাহ ইউনিয়নের বাসিন্দা অজি উল্যাহ ছয় বছর আগে সৌদি আরবে চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। সঞ্চয় ভেঙে তিনি একটি পোলট্রি খামার গড়ে তোলেন। করোনাকালে বড় লোকসানের পর আবার ধারদেনা করে ব্যবসা চালু করেন। গত রমজান থেকে ব্যবসা কিছুটা চাঙ্গা হলেও নতুন করে বিপদে পড়েছেন অজি উল্যাহ। তাপপ্রবাহ ও লোডশেডিংয়ের কারণে একের পর এক মুরগি মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রামে দৈনিক ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। ফ্যান চালানো যাচ্ছে না, রাতে আলো দেওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন খামারের ৫-৬টি মুরগি মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি ডিম উৎপাদনও কমে গেছে।

অজি উল্যাহর মতো দেশের অন্য খামারিরাও বিপাকে পড়েছেন। খামারে বৈদ্যুতিক পাখা সংযুক্ত করলেও লোডশেডিংয়ের কারণে তা কাজে আসছে না। এতে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা করছেন খামারিরা।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা আঘাত হানার আগে দেশে পোলট্রি খামার ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৭৯টি। বর্তমানে চালু আছে ৯৫ হাজার ৫২৩টি। বাকিগুলো নানা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের কাঠাতলী গ্রামের খামার মালিক আব্দুর রহমান বলেন, ‘২০ দিন আগে ৫ হাজার ২৫০টি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা তুলেছিলাম। বর্তমানে একেকটি এক থেকে দেড় কেজি হয়েছে। অতিরিক্ত গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে হিট স্ট্রোকে প্রতিদিন মুরগি মারা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ৪১টি মারা গেছে।’

ফেনীর সোনাগাজীর রসুল আহমেদের খামারে দেড় হাজার মুরগি আছে। তাঁর জেনারেটর নেই। প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। সপ্তাহখানেক ধরে দৈনিক গড়ে ৪০টির মতো ব্রয়লার মুরগি মারা যাচ্ছে। যাঁরা জেনারেটর ব্যবহার করছেন, তাঁদের প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকার তেল কিনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খোন্দকার মো. মহসিন বলেন, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি হলেই পোলট্রি শিল্পের জন্য সমস্যা। লোডশেডিং হলে ছোট খামারিরা মুরগি বাঁচাতে পারেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ছোট খামার টিকবে না।
শুধু ছোট খামারিই নন, খারাপ পরিস্থিতিতে আছেন বড় খামারি এবং মুরগির বাচ্চা, খাবার উৎপাদনকারীরাও। খাবার উৎপাদনকারীরা জানান, লোডশেডিং এবং চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে খাবার উৎপাদন প্রায় ১ লাখ টন কমে গেছে।

এদিকে গবাদি পশুর খামারিরা বলছেন, জেনারেটরের পেছনে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। কোরবানির জন্য মোটাতাজা করা গরুর খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে মনে করছেন তাঁরা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে গতকাল কয়েকটি খামার ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র গরম ও লোডশেডিংয়ের কারণে গরু-ছাগলের হাঁসফাঁস অবস্থা। বিদেশি জাতের গরুর জন্য সার্বক্ষণিক ফ্যানের ব্যবস্থা থাকে। বিদ্যুতের জন্য তাঁদের জেনারেটরে ভরসা করতে হচ্ছে। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বেড়িবাঁধের সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, চলমান লোডশেডিংয়ের কারণে খরচ ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। গরমে অনেক পশু অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেছে।

এদিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মাছের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে মাছের পোনা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য এলাকা যশোর। এ অঞ্চলে প্রতি বছর ১ লাখ ২০ হাজার কেজি বিভিন্ন মাছের পোনা উৎপাদন হয়। তবে এবার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১ লাখ কেজিতে নামিয়ে আনা হয়েছে বলে জানান যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির উষ্ণতা বেশি থাকার কারণে নদীতে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই মা মাছ ডিম ছাড়ছে না।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কে এইচ মাহবুবুল হক বলেন, সারাদেশে হ্যাচারির সংখ্যা ১ হাজার ৫৬। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত রেণু ও পোনা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। তীব্র তাপপ্রবাহে দেশজুড়ে হ্যাচারি ও প্রাকৃতিক উৎসে মাছের ডিম উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা তার কাছাকাছি থাকলে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত রেণু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাছের বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়। এই সময়টায় মাছের চাষ স্বাভাবিক না থাকলে মোট উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, খামারের মুরগি এমনিতেই খুব দুর্বল। অতিরিক্ত গরম ও ঠান্ডা কোনোটাই সহ্য করতে পারে না। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক খামারির জেনারেটর কেনার সামর্থ্য নেই। তাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ সময় খামারে টিনের চালে ভেজা চটের বস্তা, খড়, গাছের পাতা দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাঁদের নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিতে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক প্রস্তুত আছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2306177198