৯ জুন ২০২৩, শুক্রবার, ৮:২৫

সংকটে শিল্পোৎপাদন

লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি দেশের শিল্প-কারখানায় আগে থেকেই রয়েছে গ্যাসের সংকট। এতে দিনের বড় একটা সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানা। এই সংকটে বড়গুলোর সঙ্গে ছোট ও মাঝারি ধরনের শিল্প-কারখানাও বিপাকে পড়েছে। এতে উৎপাদন কমে ব্যয় বাড়ছে, প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রপ্তানির ক্রয়াদেশেও।

শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, এই সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণ করা না গেলে বড় ধরনের সংকটে পড়বে দেশের শিল্প-কারখানা ও রপ্তানি আয়। রিজার্ভেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

শিল্প-কারখানার মালিকরা বলছেন, বর্তমানে উচ্চমূল্যে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে গ্যাস কিনলেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (শিল্প-কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ) উৎপাদন করতে পারছেন না। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ দিয়ে কারখানা চালাতে গিয়ে লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন।

দিনরাতের বড় একটা সময় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে কারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি হচ্ছে। বিকল্প উপায় হিসেবে জেনারেটর দিয়ে কারখানা সচল রাখতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে দেশের বস্ত্র খাতের কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা অর্ধেকে নেমেছে।

বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। তিনি জানান, জ্বালানির সংকটে গতকাল ২৪ ঘণ্টার জন্য নিজের কারখানা বন্ধ রেখেছেন।

মোহাম্মদ আলী খোকন আরো বলেন, ঈদের আগে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে বস্ত্র খাতে দেশের ৪৫টি ব্যাংকের বিনিয়োগ করা এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ঝুঁকিতে পড়বে।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, লোডশেডিংয়ের প্রভাবে তিন সংকটে পড়েছে উৎপাদন খাত। পণ্যের গুণমান কমছে, উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, কমেছে ১০ শতাংশের বেশি উৎপাদন সক্ষমতা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত গরমে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়েছে। জ্বালানির সংকটে বাড়ানো যাচ্ছে না চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন। এতে আট থেকে ১০ দিন ধরে গড়ে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি থাকছে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো। ফলে রাজধানীসহ সারা দেশে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। তবে গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কম ছিল। লোডশেডিংও গত কয়েক দিনের তুলনায় কিছুটা কম ছিল।

উৎপাদন ও চাহিদা : পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৯টায় দুই হাজার ৮৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। ওই সময় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার মেগাওয়াট, বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১১ হাজার ৯১৭ মেগাওয়াট। দুপুর ১২টায় লোডশেডিং হয় এক হাজার ৮২৩ মেগাওয়াট। ওই সময় চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, উৎপাদন হয়েছিল ১২ হাজার ৬৭৭ মেগাওয়াট। দিনের চেয়ে রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে, তখন লোডশেডিং আরো বেশি হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘বেশির ভাগ শিল্প-কারখানা তাদের নিজেদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) দিয়ে চলে। আমরা তাদের গ্যাস সরবরাহ করছি। তারা সেই গ্যাস দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কারখানা সচল রাখছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এখন পর্যাপ্ত গ্যাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও গ্যাস বিতরণে আমরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে ছোট ও মাঝারি ধরনের শিল্প-কারখানাগুলোর বেশি ক্ষতি হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রস্তুতি থাকলেও তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়া এবং জ্বালানির অভাবে অনেক বিদ্যুেকন্দ্র চালু রাখা যাচ্ছে না। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।’ সবাইকে আরেকটু ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান তিনি।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ সরবরাহ করেছে তিন হাজার ৪৭ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৯৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

কালের কণ্ঠ’র চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চলমান লোডশেডিংয়ে কারখানায় উৎপাদন কমেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এর আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খারাপ হলে চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা থাকত বিপিডিবির। কিন্তু গত কিছুদিন দেশব্যাপী যে অব্যাহত লোডশেডিং চলছে, তা থেকে রেহাই মিলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুিবহীন থাকার প্রভাবে উৎপাদনে যেমন ধস নেমেছে, উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।
বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানার স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি। উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কমছে সক্ষমতা।

ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে ১০০ টন রড উৎপাদন করতে পারলেও জ্বালানির সংকটে এখন আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের কারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে।

পিডিবি সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হচ্ছে ৪৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।
তবে দেশব্যাপী যে লোডশেডিং, তার প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্ত চট্টগ্রামের দুই রাষ্ট্রায়ত্ত চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড। নিজস্ব বিদ্যুত্ব্যবস্থা থাকায় এই সংকটের সময়েও এই ইপিজেডে উৎপাদনপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক রয়েছে।

গাজীপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বিদ্যুত্সংকটে গাজীপুরের শিল্প-কারখানায় উৎপাদনে ধস নেমেছে। বিপাকে পড়েছেন কারখানার মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে অনেক কারখানায়।
গাজীপুর মহানগরীর বোর্ডবাজারের জাঝর এলাকার ইউনিক অ্যাপারেলসে গিয়ে দেখা গেছে, ওই কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের কেউ বাইরে, কেউ কারখানার ভেতরে আড্ডা দিচ্ছেন। সুপারভাইজার মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করি। সকাল সাড়ে ১১টায় বিদ্যুৎ চলে গেছে। এখন দুপুর দেড়টা বাজলেও বিদ্যুৎ আসেনি। গত বুধবার আড়াই শ পিস সোয়েটার কমপ্লিট হওয়ার কথা ছিল। এখনো ২০ পিসও তৈরি করা যায়নি। বিদ্যুতের অভাবে কাজ বন্ধ রয়েছে।’

গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১-এর সিনিয়র জিএম যুবরাজ চন্দ্র পাল কালের কণ্ঠকে জানান, উৎপাদন কমায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে। জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে চাহিদার কম। তাই লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জ শহরে রয়েছে প্রায় চার হাজার হোসিয়ারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বিদ্যুত্সংকটে বর্তমানে এই শিল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে উৎপাদন। এতে মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

শহরের উকিলপাড়া এলাকার নাছিমা হোসিয়ারির মালিক মো. স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিদিন ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে আমরা অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছি। এই ক্ষতি কিভাবে পোষাব, তা জানি না।’

বিকেএমইএর নির্বাহী সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুত্সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রমিকদের শরীরেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ কারণে শ্রমিকদের কাজের গতি কমে যাচ্ছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/06/09/1288085