৯ জুন ২০২৩, শুক্রবার, ৮:১৯

৯০ ভাগ সিগন্যালেরই নেই আয়ুষ্কাল

পুরোনো ব্যবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথে সবচেয়ে দুর্বল-চরম ঝুঁকির নাম ‘সিগন্যাল ব্যবস্থা’। ৯০ শতাংশ সিগন্যাল পয়েন্টের আয়ুষ্কাল প্রায় অর্ধশত বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে।

আর নামমাত্র স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পয়েন্ট থাকলেও ‘ম্যানুয়ালি’ সিগন্যাল ব্যবস্থা একমাত্র ভরসা। তবে এতে বিন্দুমাত্র আস্থা রাখতে পারেন না মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রেলে ছোট-বড় দুর্ঘটনার ৯৫ শতাংশই ঘটছে সিগন্যাল ব্যবস্থা ও রেললাইনের ত্রুটির কারণে।

শনিবার ভারতে করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনার পর রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা সংস্কার এবং সংশ্লিষ্টদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের অধিকাংশ সেকশনে ব্রিটিশ আমলের সিগন্যাল ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান। আর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ সিগন্যাল ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। এতে ঊনিশ থেকে বিশ হলেই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় যাত্রীবাহী দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২২ জন নিহত এবং ১২০ জন আহত হন। গত ১৬ এপ্রিল কুমিল্লার লাঙ্গলকোট এলাকায় ৭০ জন আহত হন।

বছরে রেলে ৭০ থেকে ১৩০টি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত রিপোর্ট বলছে, সিগন্যাল ব্যবস্থা ত্রুটির কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) তথ্য বলছে, এশিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ রেল অবকাঠামোর দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। দেশে ১৯৩৭ সালের সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে।

ট্রেনের সংখ্যা ও লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে-কিন্তু সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না। সিগন্যাল বিভাগে সবচেয়ে কম লোকবল। এ পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করা হলেও ৭০ শতাংশের বেশি স্বল্পতা থেকে যাচ্ছে। ৩০ শতাংশ অদক্ষ লোকবল নিয়ে ট্রেন চলছে।
গত এক যুগে ১৫৪টি নতুন ট্রেন চালু হলেও ট্রেন পরিচালনার অন্যতম অনুষঙ্গ সিগন্যাল ব্যবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন করলেও সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন উপেক্ষিত রয়েছে। রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তর সূত্র জানায়, এখনো অনেক স্টেশনে তারের কুন্ডলী দিয়ে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অথচ রেলওয়ের মাস্টারপ্লানে বলা আছে-আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে রেলপথে ট্রেনের গতি বাড়ানোসহ সার্বিক ট্রেন চলাচলের সক্ষমতা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। মাস্টারপ্লানে সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল (সিটিসি) ও কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং (সিবিআই) সিগন্যাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অথচ দেশের ৪৮৪টি স্টেশনের মধ্যে মাত্র ১২৪টি স্টেশনে সিবিআই ও সিটিসি সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে।

এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যথাযথভাবে কাজ করছে না। ফলে সংশ্লিষ্টদের ম্যানুয়ালি কাজ করতে হচ্ছে। ৭৬টি স্টেশন, স্টেশন সেকশনে কোনো ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। এ ব্যবস্থাপনায় লাইনের পাশে এক ধরনের তার ব্যবহার করে স্টেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ট্রেনের অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া বাঁশের মই ব্যবহার করে নির্ধারিত পিলারে লাল-সবুজ বাতি লাগিয়ে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার যুগান্তরকে বলেন, পূর্বাঞ্চল রেলে যে কয়টি সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে। এর অধিকাংশ আয়ুষ্কাল প্রায় চার যুগ আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের মূল কাজ হচ্ছে নিরাপত্তা ও গতি নিশ্চিত করা। অথচ আয়ুষ্কালবিহীন সিগন্যাল দিয়ে তা কিভাবে করা সম্ভব। এজন্য আমরা সর্বদা ভয়ে থাকি।

তিনি আরও বলেন, সিগন্যাল ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন দরকার। এটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে হবে। আখাউড়া-সিলেট রুটে খুবই ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। ঢাকা-জয়দেবপুর, ময়মনসিংহ-ভৈরব, ঢাকা-টঙ্গী পর্যন্ত রুটের সিগন্যাল ব্যবস্থাও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী মিজানুর রহমান যুগান্তরকে জানান, সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিক না হওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া সিগন্যাল ব্যবস্থায় যুগের পর যুগ ধরে ট্রেন চালানো হচ্ছে। পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৩০টি স্টেশনে সিবিআই সিগন্যাল ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি বলেন, আবদুল্লাপুর-পার্বতীপুর, দর্শনা-খুলনা, পোড়াদহ-রাজবাড়ী, শান্তাহার-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-কাউনিয়াসহ অধিকাংশ সেকশনে মেয়াদোত্তীর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থায় ট্রেন চালানো হচ্ছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে পরিকল্পনা সেলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতার পর থেকে রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়নে কোনো সরকারই যথাযথ কাজ করেনি। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলেও সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নে বিশেষ কোনো প্রকল্প গ্রহণ করেনি। স্টেশন মেরামত অথবা প্ল্যাটফর্ম সংস্কারসহ এমন নানা প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়ন করা হলেও সবচেয়ে গুরুত্বের সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক যুগান্তরকে জানান, মন্ত্রণালয় বা রেল বিভাগের দৃষ্টি শুধু বড় বড় প্রকল্পের দিকে। তারা হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের দিকে ছুটছে। অথচ ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কারও কোনো চিন্তা নেই। সিগন্যাল ব্যবস্থা ত্রুটির কারণেই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানি ঘটছে। রেলের সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে সিগন্যাল ব্যবস্থা সবচেয়ে আধুনিক। কিন্তু বাংলাদেশে রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা অন্ধকারে রাখা হয়েছে। নতুন ট্রেন উদ্বোধন, নতুন পথ তৈরির প্রয়োজন আছে। তবে, মনে রাখতে হবে যাত্রী সেবা-নিরাপত্তা ও রেল সম্পদ রক্ষায় আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/683828