৬ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:৩৫

জাতীয় বাজেট : জনদুর্ভোগের একটি দলিল

ড. মো. নূরুল আমিন

গত পয়লা জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। বাজেটটির মোট আকার ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা। এতে আয় ধরা হয়েছে ৫,০৩,৯০০ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ২,৫৭,৮৮৫ কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১,৩২,৩৯৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১,০২,৪৯০ কোটি টাকা। ঘোষণা অনুযায়ী এতে উন্নয়ন বাজেট তথা এডিপি বরাদ্দ হচ্ছে ২,৬৩,০০০ কোটি টাকা। বাজেটে মোট কর বাবত আয় ধরা হয়েছে ৪৩০০ বিলিয়ন টাকা (৫৬.৪%) এর মধ্যে রয়েছে ভ্যাট বাবত ৩৮.১%, আমদানি শুল্ক বাবত ১০.৭%, আয়কর বাবত ৩৫.৬%, অতিরিক্ত শুল্ক ১৪.১% এবং বিবিধ বাবত ১.৪%, অন্যান্য প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণ ২০.৪%, বৈদেশিক ঋণ ১৩.৫%, বৈদেশিক অনুদান ০.৫%, কর বহির্ভূত আয় ৬.৬%, এনবিআর উৎস থেকে কর ৫৬.৪% এবং এনবিআর বহির্ভূত আয় ২.৬%।

বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, অর্থমন্ত্রী তার প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছেন জনপ্রশাসন খাতকে (২২.০%) দ্বিতীয় স্থানে আছে শিক্ষা ও প্রকৌশল খাত (১৩.৭), তৃতীয় স্থানে ঋণের সুদ পরিশোধ খাত এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ (১১.৫%)। এরপর স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ৬.৫%, কৃষি ৫.৭, প্রতিরক্ষা ৫.৫%, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৫.৩%, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি ৪.৬%, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ৪.২%, গৃহায়ণ ১%, ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিনোদন ০.৭% এবং বিবিধ বা থোক বরাদ্দ ১.২%।
বাজেটটির সম্পদ বরাদ্দ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাজেটটি জনগণের চাহিদা ভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে দলন নিপীড়নমুখী একটি বাজেট। জনপ্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা খাতে প্রদত্ত বরাদ্দ যোগ করলে উভয় খাতের মিলিত বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬.২%। অর্থাৎ বাজেটের এক চতুর্থাংশেরও বেশি আমলাতান্ত্রিক ও পুলিশী ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হবে। উৎপাদন খাতসমূহে যে বরাদ্দ তাতে কর্মচারীদের বেতন ভাতার অর্থ বাদ দিলে যে অর্থ অবশিষ্ট থাকবে তা ভাগ বাটোয়ারাতেই শেষ হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে।

বাজেটের অর্থ সংগ্রহের জন্য অর্থমন্ত্রী করারোপের নতুন নতুন খাত অন্বেষণের আভাস দিয়েছেন। দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষের অবস্থা নতুন করের চাপে আরো খারাপ হতে পারে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের বাজেটে সুদ তৃতীয় বৃহত্তম খাতে পরিণত হয়েছে, যে সুদ হারাম এবং অত্যন্ত গর্হিত একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার বিদ্যমান ৮.৬ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৬.০০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগামী অর্থবছরে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি। বিশাল ঘাটতির এই বাজেটটির অর্থায়ণের জন্য অর্থমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অতীতের বছরগুলোতেও তারা এই কাজ করেছেন। তারা ইচ্ছামতো তফসীলি ব্যাংকগুলো থেকে যেমন ঋণ নিয়েছেন তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছেন এবং আগামী বছরও তাই করবেন। Deficit Financing এ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নোট ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়। এতে বাজারে Money Circulation বেড়ে যায় যা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। আবার তফসীলি ব্যাংক থেকে বৃহৎ পরিসরে সরকার ঋণ নিলে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ সুবিধা সংকুচিত হয়ে পড়ে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। উন্নয়ন বাজেট তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি হচ্ছে বাজেটে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে একমাত্র সরকারি intervention. বাজেটে এডিপির আওতায় যেসব নতুন ও পুরাতন প্রকল্প রাখা হয়েছে তার সিংহভাগই অবকাঠামো তৈরি ও সংস্কার সংক্রান্ত, উৎপাদন খাতে কোন প্রকল্প নাই বললেই চলে। উৎপাদন বহির্ভূত খাতের বিনিয়োগ মূল্যস্ফীতিই ঘটায় এবং এতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। এই সরকারের আমলে বিগত বছরসমূহে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার অবকাঠামো তথা দেশব্যাপী অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, রেললাইন সম্প্রসারণ প্রভৃতি তৈরি ও সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে। এতে লাভ হয়েছে ঠিকাদার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও আমলাদের। যে রেল গত দু’দশকে কখনো লাভের মুখ দেখেনি, প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার কোটি থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে, ভারতীয় স্বার্থে সেই রেলের সংস্কার ও সম্প্রসারণ কতটুকু যৌক্তিক?

বাজেটে দুর্নীতি, পুঁজি পাচার রোধ এবং ইনসাফ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনও দিকনির্দেশনা নেই। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপের (PPP) নামে সরকার গত পনের বছর ধরে জনগণের অর্থ লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে। মোটা, মাঝারী ও চিকন জাতের ভাতের চাল প্রতিকেজি যথাক্রমে ১০, ১২ ও ১৪ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫, ৬০ ও ৭৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। পোলাওর চালের দাম যেটা এই সরকার আসার আগে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি ছিল এখন তা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় এসে ঠেকেছে। চিনির কেজি ছিল ৩৪/৩৫ টাকা, এখন ১৪০/১৫০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের তরফ থেকে দুর্বিষহ এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য দেশের ছয়টি নেতৃস্থানীয় শিল্প গোষ্ঠী কর্তৃক গঠিত সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠজনরা আছেন। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১১ বছরে দেশ থেকে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনার ব্যাপারে বাজেটে কোনও ব্যবস্থার কথা উল্লেখ নেই। একইভাবে খেলাপী ঋণ আদায়ের ব্যাপারেও অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেননি। বলাবাহুল্য ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১,০০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এর পরিমাণ হচ্ছে ১,৩১,০০০ কোটি টাকা। বাজেটে সরকার পরোক্ষ কর আদায়ের ওপর জোর দিয়েছেন। ফলে এই বাজেট ধনীদের তোষণ ও গরিবদের মারার হাতিয়ারে পরিণত হবে। মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষ, যাদের আয় করসীমার নিচে তাদেরও অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে, না হয় রাষ্ট্র প্রদত্ত ৪৪টি সেবা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। বৃটিশ আমলে ভারতের চব্বিশ পরগনার নারকেল বাড়িয়ার জমিদার কৃষক রাজা কর্তৃক মুসলমানদের দাড়ি প্রতি পাঁচ সিকে (এক টাকা চারআনা) কর ধার্য করার একটি গল্প প্রচলিত আছে। অর্থমন্ত্রী একদিকে করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েছেন অন্যদিকে করসীমার নামে যেসব দরিদ্র মানুষের উপার্জন তাদের ওপরও কর আরোপ করেছেন। এই পদক্ষেপটি যেমন অযৌক্তিক তেমনি ইনসাফেরও পরিপন্থী। বাজেট ঘোষণা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী তিনটি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছেন বলে মনে হয়। প্রথমতঃ পর পর দু’বছর (২০২০-২০২১) করোনা মহামারির তা-ব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক এবং শিক্ষাখাতে যে বিপর্যয় ও তা-ব সৃষ্টি করেছিল তার জের এখনো চলছে। দ্বিতীয়তঃ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধও বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব এবং ডলার সংকট। বহু দেশ বাংলাদেশি ব্যাংকসমূহের এলসি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে এবং বাংলাদেশ সরকার আমদানি বাণিজ্যের অর্থায়নে হিমশিম খাচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রায় পণ্য আমদানির ব্যয় মেটানোর প্রস্তাব উঠছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়তঃ এই সরকারের মেয়াদ ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচিত নতুন সরকারকে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য নতুন করে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। বাজেটের আকার নির্ণয় ও বরাদ্দে এই বাস্তবতাগুলো অনুপস্থিত।

অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে প্রাপ্য তথ্যানুযায়ী প্রতিটি অর্থবছরেই বাজেটের বাস্তবায়ন একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। অর্থবছরের ১০ মাসে কখনো বাজেটের ও এডিপির ২৫/৩০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না, শেষ দু’মাসে অর্থাৎ মে-জুনে বাকি ৭০/৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন প্রদর্শন করা হয়। এজন্য সরকারি অফিসগুলোতে June Closing কোন কোন সময় ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। আইএমইডি নামক সরকারের একটি বিভাগ আছে। কিন্তু তার দাঁত-নখ কোনোটাই নেই, ঠুঁটো জগন্নাথ। এখানে Financial Progress এবং Physical Progress এর মধ্যেও কোনো মিল পাওয়া যায় না। সূত্র অনুযায়ী গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিগত বাজেট বরাদ্দের ২০.১৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এর জন্য পরিচালনা বাজেটের (Operating Budget) ৪৬.৯% ব্যয় হয়েছে। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধ। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। কেননা ঋণ করেই সরকার ঘি খেতে অভ্যস্ত। প্রকল্পের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার মেয়াদ সীমিত। একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং এই সময়কে মাথায় রেখেই বাজার দর, মূল্যস্ফীতি ও কন্টিনজেন্সি বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। দুঃখজনকভাবে এই সরকারের আমলে শতকরা ৯০ ভাগ প্রকল্পই নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ হয় না, তার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় এবং ব্যয় বরাদ্দ অযৌক্তিকভাবে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। এভাবে রাষ্ট্রীয় লুটপাট চলে। প্রত্যেক বছর বিশাল বিশাল বাজেট পেশ করা হয়। অথচ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য আমলা ও সরকারি বিভাগ ও এজেন্সিসমূহের সামর্থ্য বৃদ্ধির কোনো ব্যবস্থা করা হয় না অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা প্রভৃতি বৃদ্ধিরও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের কোনো পদক্ষেপও নেয়া হয় না। সরকার ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস করেছেন, এতে Debt Servicing করতে গিয়ে ডলারের অতিরিক্ত দায়ের সৃষ্টি হয়েছে। তা মেটানোর জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে তাকে ধর্ণা দিতে হচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে কড়া শর্তে ঋণ নিয়ে সাধারণ বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

বলাবাহুল্য অর্থমন্ত্রী বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের জন্য মোট ২,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১,৫১,০০০ কোটি টাকা যা মোট ঘাটতির ৫৭.৬৮ শতাংশ। এই পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে আসবে ১,২৮,০০০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে আসবে ২৩,০০০ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১,১০,৭৮৫ কোটি টাকা আসবে বিদেশী ঋণ থেকে। পরিচালনা ব্যয়ের মধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে বাজেটের ১২.৩৮ শতাংশ অর্থাৎ ৯৪,৩৭৮ কোটি টাকা। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে (যেমন বয়স্কভাতা, বিধবা ও দুস্থ মহিলা ভাতা) সুবিধাভোগীর সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ খাতে অর্থ বণ্টন ও সুবিধাভোগী নির্বাচনে দুর্নীতি ও অনিয়মের যে অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, তা দূর করার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

বাজেটে সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর একটি প্রস্তাব অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকরা যদি এই পেনশনের জন্য তালিকাভুক্ত হয় এবং ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত অথবা কমপক্ষে ১০ বছর পর্যন্ত নির্ধারিত হারে চাঁদা পরিশোধ করেন তাহলে তারা এই পেনশন প্রাপ্তির যোগ্য বিবেচিত হবেন। ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত তারা পেনশন পাবেন। যদি কেউ ৭৫ বছর বয়স পূর্তির আগে মারা যান তাহলে তার বা তাদের নমিনিরা উক্ত মেয়াদ পর্যন্ত পেনশন পাবেন। প্রস্তাবটি ভালো, তবে এই প্রস্তাবের অনুকূলে যেমন কোনো বরাদ্দ নেই তেমনি প্রস্তাবিত স্কিমের বিস্তারিত নিয়ামাবলী ও শর্তও উল্লেখ নেই। ফলে প্রস্তাবটি অন্তঃসারশূন্য বলেই মনে হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার ইতিপূর্বে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা শতভাগ পেনশন সমর্পণ করেছিলেন, অবসরের ১৫ বছর পূর্তির পর তাদেরকে পুনরায় নিয়মিত মাসিক পেনশনের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ ঘোষণাটিও পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা ও এজেন্সির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে বাধ্য হয়েছেন। সরকার যা করতে পারবেন না তা ঘোষণা না করাই ভালো।

অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বিরাট একটি সাফল্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন যে, তার দল সরকারে আসার পর গত দেড় দশকে ২ কোটি ৩৫ লক্ষ লোকের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৫৭২টি আইন প্রণয়ন করেছেন। তার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার করা হয়েছে। দেশে মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার গোল্ডেন জুবিলী পালন করা হয়েছে। তার বর্ণিত অর্জনগুলো সুশাসন তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কতটুকু ভূমিকা রেখেছে দেশবাসীর কাছে তা পরিষ্কার নয়। তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হচ্ছে তাদের জান-মাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং মৌলিক মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা যা এখন নেই। বাজেটটি জনবান্ধন নয়, ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়ার বাজেট।

https://dailysangram.info/post/526604