২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৩৭

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়!

|| মো. তোফাজ্জল বিন আমীন || গণমানুষের অধিকারের কথা যে সমাজ বা রাষ্ট্রে বলা যায় না সেখানে গণপরিবহনে নৈরাজ্য হওয়াটা তো স্বাভাবিক। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের জনগণ যখন শুধুমাত্র ভোগবিলাস আর অর্থ বিত্তের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তখন আর সুশানের কথা কেউ ভাবে না। মানুষ মানুষের জন্যে জীবন জীবনের জন্য এই কথাটি গানের পংক্তিমালায় শোনা গেলেও বাস্তবে তেমনটা খুব বেশি দেখা যায় না। গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল টার্গেট হলেও ক্ষমতাসীনরা কখনও কখনও গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে চান না। আর তখনই গণতন্ত্র ও সুশাসনের অনুপস্থিতিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নৈরাজ্যের সব অজানা পথ। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে রাজনীতি আর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে পেশীশক্তির মহরা যখন রাষ্ট্রে বিরাজ করে তখন রাষ্ট্রের জনগণের উপর নৈরাজ্যের খড়গ নেমে আসে। একাকী একটু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে নৈরাজ্যের সূচনা আছে শেষ নেই। নৈরাজ্য নেই কোন খানে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত,সমাজ, রাষ্ট্র কী পরিবার সর্বত্র লক্ষ্য করলেই নৈরাজ্যের পদধ্বনি শোনা যাবে। এই নৈরাজ্যের অবসান সবারই কাম্য। কিন্তু নৈরাজ্যের পেছনে যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তার অবসান না হলে সমাজ, রাষ্ট্র থেকে নৈরাজ্য দূর করা সম্ভব হবে না। সামাজিক অবিচার ও বৈষম্য মানুষের জীবনকে অস্থির ও দুঃখময় করে তুলেছে। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরেও সত্য কথা খুব কমই শোনা যায়। বর্তমান সভ্যতায় মজলুম মানুষের কান্নার আওয়াজ কান পাতলেই শোনা যায়। তাদের পক্ষে কথা বলা বা লেখার মানুষ নেহায়েত কম বিধায় মজলুম মানুষের মুক্তির পথ কঠিন। চাওয়া পাওয়ার এই পৃথিবীতে শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের দুঃখ বেদনা ও হাহাকারের মাত্রা তীব্র থেকে ত্রীবতর হলেও নীরব ভূমিকা পালন করছে মুসলিম নামধারী ক্ষমতাসীন শাসকেরা। নৈতিকতার অধঃপতন যদি ঠেকানো যায় তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও নৈরাজ্যে কমবে বৈ বাড়বে না। পরিবহন খাতে নৈরাজ্য বন্ধের দাবির বিষয়টি অনেক পুরানো। এই সেক্টরের শৃঙ্খলা বিধানের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বহু লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। তারপরেও পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যের লাগাম টেনে ধরা যায়নি।
গত ৪ এপ্রিল গণপরিবহনের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। সে অনুযায়ী ১৬ এপ্রিল থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত তা হয়নি। বরং উল্টো লোকাল বাসে সিটিং ভাড়া আদায় করেছে মালিকপক্ষ। আবার বাস রাস্তায় না নামিয়ে ইচ্ছেকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রাজধানীবাসীকে চরম দুর্ভোগে ফেলে দেয় বাস মালিকরা। বিআরটিএ-এর চেয়ারম্যান বলেছেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর গত কয়েকদিনে সাধারণ মানুষকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, সে কারণেই ১৫ দিনের জন্য সিটিং সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিআরটিএ-এর ঘোষণার পর সাধারণ নাগরিকেরা মনে করছেন এটা একটা নাটক। অনেকে মনে করছেন এটা একটা কারসাজি। নতুন কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্যেই একটু টেস্ট করা হয়েছে। যারা চালাকি করেন তারা ভাবেন মানুষ আমার চেয়ে বোকা। অন্যকে বোকা খানিক সময়ের জন্য হয়তো বানানো যায় কিন্তু বার বার বোকা বানানো যায় না। যে দেশের ভিক্ষুক মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে জানে সেদেশের মানুষকে বোকা বানানো এত সহজ না। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাজধানীতে চলমান জনভোগান্তির পেছনে শাসক দলের নেতাদের প্রধান ভূমিকা রয়েছে। এসব নেতারা অসংখ্য বাসের মালিক পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকদের নেতাও বটে। গত ১লা মার্চের পরিবহন ধর্মঘটের কথা নিশ্চয় পাঠকদের মনে থাকার কথা। একজন বাস চালকের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের নামে সারা দেশে পরিবহন সেক্টরের অরাজকতায় ভোগান্তিতে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে হয়েছে হাজারো এসএসসি পরীক্ষার্থীকে। দুঃখজনক হলেও সত্য সরকারের নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের সরকারি বাসায় বসে পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা ধর্মঘট করার ঘোষণা দেন। মন্ত্রীর বাসায় পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হলে সরকারের অবস্থান কোথায় তা সহজে অনুমেয়। পরিবহন ধর্মঘটের প্রথম দিন পুলিশের নিস্ক্রিয়তায় ব্যাপক ভাংচুর অরাজকতার ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় দিন গাবতলীতে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে একজনের প্রাণহানি ঘটে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারদলীয় মন্ত্রী পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষে সাফাই গাইলে কোন সমস্যা হয় না। শ্রমিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মন্ত্রী বলেন, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাজপথে কর্মসূচি দিতেই পারে। অথচ শ্রমিকদের ধ্বংসলীলার কর্মসূচি চলার সময় মন্ত্রী বলেন, ‘পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে জামায়াত বিএনপি ঢুকে গেছে। সব ব্যর্থতার দায় জামায়াত বিএনপির উপর চেপে দিলেই কী সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে?
রাজধানী ঢাকায় সড়ক পথে বিরাজমান নৈরাজ্য ও দেশের সন্তানতুল্য নাগরিকের ভোগান্তি দেখেও দেখছে না সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা শহরে প্রায় দেড় কোটিরও অধিক লোক বসবাস করছে। পরিবহন সংকটের কারণে রাজধানীবাসী চরম বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সকালে অফিসের সময়ে এবং বিকেলে অফিসফেরত মানুষেরা। এতগুলো মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে সরকার তামাশা দেখছে। সরকারের কারণেই পরিবহন ক্ষেত্রে এ নৈরাজ্যজনক অবস্থা চলে আসছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার জনগণের নির্বাচিত নয় বলেই তারা জনগণের ভোগান্তি দেখেও দেখছেন না। গণপরিবহন মধ্যবিত্তের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হলেও জনগণের ভোগান্তির শেষ নেই। বাসের হেলপার কন্ডাক্টর ও চালকদের অভদ্র আচরণের কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। অনেক সময় প্রতিবাদ জানাতে গেলেই তেড়ে আসে। টানা চারদিন সীমাহীন ভোগান্তির পর অতিরিক্ত ভাড়ার খড়গ আবার যাত্রীদের কাঁধেই চাপিয়ে দেয়া হলো। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কৃত্রিম সংকটের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একই গোষ্ঠীর সুচিন্তিত পরিকল্পনা। আর বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রীর সর্বশেষ বক্তব্যেও। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী পরিবহনে নৈরাজ্য নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেছেন। এতে জাতি হতাশ। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক তিনি। এর পরও তাঁর এই অসহায়ত্ব প্রমাণ করে আমরা কতটা জিম্মি সিন্ডিকেটের কাছে। সরকার ও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কিছু লোক কিভাবে সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কিন্তু জনগণ জানতে চায় এসব ক্ষমতাধর লোক কারা? তারা সরকারের লোক নাকি অন্য কেউ তা জাতির সামনে প্রকাশ করতে বাধা কোথায়?
ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহর দুনিয়াতে কমই আছে। প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ২০ হাজারের উপরে মানুষ বসবাস করছে। দীর্ঘদিন থেকে গণপরিবহন ব্যবস্থায় চলছে চরম নৈরাজ্য। একদিকে ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম, অন্যদিকে অপ্রতুল যানবাহন প্রতিনিয়ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ছিনিয়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন থেকে। গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধের পরিবর্তে মালিকপক্ষ বা প্রভাবশালী মহলের কাছে আত্মসমর্পণ কোন বিবেচনাতেই কাম্য নয়। সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের ভোগান্তি বন্ধ করা যেমন প্রয়োজন তেমনি লোকাল পরিবহনের নামে নৈরাজ্যের টুঁটিঁ চেপে ধরা উচিত। দেশের সন্তানতুল্য নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব। দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা সরকার গণপরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য বন্ধের ব্যাপারে আন্তরিক ও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে ইঁদুর বিড়াল খেলা বন্ধ করবে।

http://www.dailysangram.com/post/281077-