ফসলহারা এবং ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরাজিত নিঃস্ব কৃষকের বসে থাকা l ছবি: প্রথম আলো
২৪ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৩৫

দেখা থেকে লেখা

সুনামগঞ্জ কি এখনো দুর্গত নয়?

শনিবার সন্ধ্যায় ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘হাওর বাঁচাতে চাচ্ছেন কেন? হাওর কি মরে যাচ্ছে?’

তিনি বললেন, ‘আক্ষরিক অর্থে এখনই মরে যাচ্ছে না। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে হাওরগুলোর একধরনের মরণপ্রক্রিয়া চলছে। সুনামগঞ্জের নদী ও হাওরগুলোর তলদেশে পলি জমে উঠছে। তাই অতিবৃষ্টি হলে এবং পাহাড়ি ঢল এলে হাওরের ফসলহানি ঘটছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে আরও নানা রকমের অস্বাভাবিকতা দেখা দিচ্ছে।’
বললাম, ‘এটা তো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এ থেকে নদী কিংবা হাওরকে বাঁচানোর উপায় কি মানুষের হাতে আছে?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু উপায় তো অবশ্যই আছে। আরও উপায় খুঁজে পেতে হবে।’
‘কী উপায় আছে?’
‘নদী ও হাওরের বিলগুলো নিয়মিতভাবে খনন করা একটা উপায়। আমরা এটার কথাই বলছি। এভাবেই হাওর বাঁচানোর দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কথায় কর্ণপাত করা হচ্ছে না। খনন করার পরিবর্তে প্রতিবছর বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করার অজুহাতে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। বাঁধগুলো যদি সময়মতো সঠিকভাবে মেরামত করা হতো, তাহলে এই বৈশাখে পাহাড়ি ঢল এসে যে ব্যাপক ফসলহানি ঘটাল, তা ঘটত না। অন্তত কিছু ধান রক্ষা পেত।’
‘কোটি কোটি টাকা কারা লোপাট করে?’
‘পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফসল রক্ষা বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি আর ঠিকাদারেরা মিলে। এই তিন পক্ষ একজোট হয়ে একটা স্থায়ী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী। বছরের পর বছর এরা একইভাবে পুকুরচুরি করে চলেছে, কিন্তু এই সিন্ডিকেট কেউ ভাঙতে পারছে না। হয়তো ভাঙতে চাচ্ছেও না। ঠিকাদারদের বাঁধ মেরামত করার কথা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। এবার তারা সময় বাড়িয়ে নিয়েছিল ৩১ মার্চ পর্যন্ত, কিন্তু কই? সেই সময়ের মধ্যেও তো তারা কাজ করেনি। আপনি যদি হাওরের গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেন, তারা আপনাকে বলবে, তারা ঠিকাদারদের দেখা পায়নি। অথচ ঠিকাদারেরা সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নেয়। বাঁধ মেরামতের নামে প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঠিকাদারেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে নেয়। কিন্তু মাটি কাটে কোদালে না, কলমে।’
অর্থাৎ, ভদ্রলোক বলতে চাইলেন, ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামতের কাজটা সীমাবদ্ধ থাকে কাগজ-কলমের হিসাবের মধ্যেই। বাস্তবে কাজ হয় অতি সামান্য। একটু পরেই তিনি আবার ফিরে গেলেন খননের কথায়। বললেন, বেড়িবাঁধ ফসল রক্ষার একটা সাময়িক উপায়। কিন্তু নদীগুলোর তলদেশ যদি উঁচু হতেই থাকে, তাহলে একটা সময়ে বাঁধ দিয়েও আর ফসল রক্ষা করা যাবে না। হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ি ঢল এসে নদীর দুই কূল উপচে হাওরে পানি ঢুকে পড়বে। তা ছাড়া বাঁধগুলোতে যে প্রতিবছর মাটি তোলা হয়, সেই মাটিও তো ÿক্ষয়ে ক্ষয়ে গিয়ে হাওরেই পড়ে। এভাবে হাওরের গভীরতাও কমে যাচ্ছে। তাই খনন করা ছাড়া হাওর বাঁচানো যাবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচিত খননের জন্য সরকারের কাছ থেকে অর্থ চাওয়া, সেই অর্থের সদ্ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে নদী ও হাওরের বিলগুলো খনন করা। হাওর বাঁচানোর আপাতত এটাই উপায় এবং এই উপায় অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। নইলে সুনামগঞ্জ বাঁচবে না, সুনামগঞ্জের ২৫ লাখ মানুষ বাঁচবে না। কারণ, হাওরই সুনামগঞ্জের প্রাণ।
২.
রোববার বেলা ১১টার দিকে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামকে তাঁর অফিসে ব্যতিব্যস্ত দেখতে পাই। শনির হাওর নামে যে হাওরটির ফসল ঢলের পানি থেকে রক্ষা পেয়েছিল, এখন সেটার ভেতরেও পানি ঢুকতে শুরু করেছে। তিনি টেলিফোনে তাঁর অধস্তন কোনো কর্মকর্তাকে সে বিষয়েই জরুরি নির্দেশ দিচ্ছিলেন। টেলিফোনে তাঁর কথা শেষ হলে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, যে ফসলহানি ঘটেছে তা কি অনিবার্য ছিল? ঢল প্রতিরোধ করে ধান বাঁচানোর কোনো উপায়ই কি ছিল না?
উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটা এমন আকস্মিক এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা থেকে ফসল বাঁচানোর বিশেষ কোনো উপায় ছিল না। কারণ, পানির উচ্চতা ৬ দশমিক ৫ মিটার হলে আমরা সেটাকে বিপৎসীমা বলি। বাঁধগুলোও এ রকম উঁচু করে নির্মাণ হয়। কিন্তু এবার পানির ঢল এসেছে বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে। সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৯ মিটার পর্যন্ত পানি উঠেছে। সে কারণেই হাওরগুলো তলিয়ে গেছে।’ আমি বললাম, ‘তাহলে কি বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে?’ তিনি বললেন, মাটি-বালুর এই বাঁধ ব্যবস্থা দিয়ে আর চলবে না। অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এগুলো খনন করে নাব্যতা বাড়াতে হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, মানুষের অবস্থা এখন কেমন দেখছেন? তারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? তিনি বললেন, ‘বিপুল ক্ষতি হয়েছে।’ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আপনারা কী করছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ক্যাশ টাকা দেওয়া হচ্ছে, এই বাবদে ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরও বরাদ্দ আসবে। এ ছাড়া স্বল্প দামে চাল বিক্রির কর্মসূচি চলছে। এর আওতা ইউনিয়ন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির প্রক্রিয়াও চলছে। তা ছাড়া চলছে ভিজিএফ কর্মসূচি।
আমি বললাম, ১৫ বা ১০ টাকা যত কম দামেই চাল বিক্রি করা হোক, সেই চাল কেনার জন্য যে টাকা দরকার, মানুষের হাতে তো তাও থাকবে না। কারণ, তারা সবকিছু হারিয়ে একদম নিঃস্ব হয়েছে। তিনি সায় দিয়ে বললেন, সেটা ঠিক। তবে ভিজিএফ কর্মসূচি আছে। আমি ভিজিএফ কর্মসূচি সম্পর্কে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের কথা তুললে তিনি বললেন, সবকিছু কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে। কোনো রকমের অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ থাকবে না।
আপনার কি মনে হচ্ছে না, একধরনের দুর্ভিক্ষ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে? তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললাম, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি উঠেছে। আপনার কি মনে হয় না, এই দাবি মেনে নেওয়া উচিত? তিনি বললেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
বললাম, যে কৃষক ৩৬ বিঘা জমির ধান হারিয়েছেন আর যে কৃষক পাঁচ বিঘা জমির ধান হারিয়েছেন, তাঁরা এখন উভয়ে একই রকমের নিঃস্ব। এখন তাঁদের আগামী মৌসুম পর্যন্ত টিকে থাকার একটা উপায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা। কিন্তু হাওরের বিলগুলো লিজ দেওয়া হলে তাঁরা মাছও ধরতে পারবেন না। তখন তাঁদের হাতে ওএমএসের চাল কেনার টাকাও থাকবে না। তাহলে তাঁরা বাঁচবেন কীভাবে?
ডিসি সাহেব বললেন, দেশের অন্যান্য জেলায় উদ্বৃত্ত ফসল হয়েছে, উদ্বৃত্ত খাদ্য মজুত আছে। কেউ না খেয়ে মারা যাবে না। বললাম, উদ্বৃত্ত খাদ্য মানে তো শুধু চাল। কিন্তু মানুষের কি শুধু ভাত খেলেই চলে? তার অন্যান্য পুষ্টিরও তো প্রয়োজন। তিনি আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন, কিন্তু কোনো সমাধান বাতলে দিতে পারলেন না।
সুনামগঞ্জে কোনো কলকারখানা নেই, ৪৩ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী, বাকিরা মৎস্যজীবী। অন্যান্য পেশার মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ঢলের পানিতে ধান নষ্ট হয়ে গেল। যদিও এই মুহূর্তে মাছ মরে যাওয়ায় একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে লোকজন এই আশাও প্রকাশ করছে যে এবার হাওরে প্রচুর মাছ হবে। আগের পানি এলে মাছ ভালো হয়। ধান আর মাছই যখন সুনামগঞ্জের জীবন-জীবিকার উৎস, তখন ধান হারিয়ে মানুষ মাছের আশায় বুক বাঁধছে। কিন্তু মাছ ধরার সুযোগ অবারিত নয়। যারা মাছ ধরার সুযোগ পাবে না, তাদের কী দুর্দশা হবে তার কিছু আভাস পেয়েছিলাম আগের দিন দুপুরে ঘাগটিয়া গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময়। সেখানে এক যুবক আমাকে বলছিল, আমরা শেষ। সরকার যদি আমাদের কথা শোনে, তাহলে সরকারকে বলবেন, ‘আমাদের তো আর কিছু নাই, আমরা যেন হাওরে মাছ ধরে বেঁচে থাকতে পারি। সরকার যেন হাওর বড়লোকদের লিজ না দেয়। লিজ দিলে আমরা মাছ ধরতে পারব না। আর মাছ ধরতে না পারলে আমরা না খেয়ে মরে যাব।’
এই প্রসঙ্গ তুলে আমি ডিসি সাহেবকে বললাম, হাওরের বিলগুলো লিজ না দিয়ে সবার মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় না? তিনি বললেন, সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। বললাম, আপনিও তো সরকারের অংশ। তিনি বললেন, ‘নদীগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। নদীতে মাছ ধরায় কারও কোনো বাধা নেই।’
বুঝলাম, সরকার হাওরের বিলগুলো লিজ দেবে, সবার মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত করবে না। কিন্তু এটা না করলে দুর্গত
দরিদ্র কর্মহীন মানুষগুলোর বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়বে। হাওরের দুর্গত মানুষের জন্য সরকার এখন যেসব সাহায্য-সহযোগিতা করছে বলে বলা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সহযোগিতা করা হবে যদি হাওরে সব মানুষের মাছ ধরার সুযোগ অবারিত করা হয়।
সরকার সুনামগঞ্জের হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকাও ঘোষণা করবে না। ত্রাণসচিব এখানে এসে বলে গেছেন, কোনো এলাকাকে দুর্গত ঘোষণা করতে হলে সেখানকার ৫০ শতাংশ মানুষকে মারা যেতে হবে। সুনামগঞ্জের মানুষের এই চরম দুর্দিনে এমন অসংবেদনশীল উক্তি স্বভাবতই প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ মানুষ মানববন্ধন করেছে। স্থানীয় সংবাদপত্রে ত্রাণসচিবকে ধিক্কার জানিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে।
১ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমির সব ধান সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে, কৃষকের গবাদিপশুর খাবার ধ্বংস হয়েছে, মানুষ মাছও হারিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন, তাদের অনাহার-অর্ধাহার শুরু হয়েছে এবং তাদের সামনে পড়ে আছে এমনই কর্মহীন দুর্দশাময় পুরো একটা বছর। এত কিছুর পরেও কি সুনামগঞ্জ দুর্গত এলাকা নয়? তাহলে দুর্গত আর কাকে বলে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
mashiul.alam@gmail.com

 

http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1155371/